০৫:৫২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জগদ্বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু

জগদীশচন্দ্র বসু। ফাইল ছবি

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহ জিলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মসুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু। তিনি ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জগদীশ চন্দ্রের জন্মের সময় তিনি ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ইতোপূর্বেই তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে। এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। জগদীশচন্দ্রের পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রথম বাংলা স্কুলের অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল।

জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খৃষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোক। বাবার ইচ্ছা ও আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।

তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসু’র আনুকুল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন।

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল জর্জ রবিনসন (প্রথম মার্কুইস অব রিপন)-এর অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি এই নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন। এখানে যোগদানের পর বসু নানাধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তাঁকে গবেষণার জন্য কোনরূপ সাহায্য দেয়া হতো না এবং তাঁর বেতনও ইউরোপীয় অধ্যাপকদের বেতনের অর্ধেক ছিল। এর প্রতিবাদে বসু বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন এবং তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রতিবাদের ফলে তাঁর বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন রকম উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় ২৪ বর্গফুট (২.২ মি^২) একটি ছোট ঘরে তাঁকে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হতো। পদে পদে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর বিজ্ঞান সাধনার প্রতি আগ্রহ ভগিনী নিবেদিতাকে বিস্মিত করেছিল। কলেজে যোগ দেওয়ার এক দশকের মধ্যে তিনি বেতার গবেষণার একজন দিকপাল হিসেবে উঠে আসেন।

১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে অবলার বিয়ে হয়। অবলা ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা। বিয়ের আগে অবলা বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন মেয়েদের পড়ানো নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে আবার তিনি তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তাঁর পরিবারকে পথে বসতে হয়। এর মধ্য থেকে অবলা ও জগদীশ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। সব ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন মাত্র বসুর পিতা-মাতা জীবিত ছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের ‘রয়েল সোসাইটি’র জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন তখন তিনি এই গবেষণার কাজ করতেন। তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে কোন উন্নতমানের গবেষণাগার ছিলনা, অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে নিজ খরচে তিনি স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তাঁর এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। এ সকল সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে এসেছিলেন।

জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্‌ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য হের্‌ৎস চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তা শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করে। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্‌স”। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান। জগদীশ এবং অবলা দু’জনকেই তিনি তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এই বিষয়ের উপর বিখ্যাত সাময়িকী “টাইম্‌স”-এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় যাতে বলা হয়, “এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কেমব্রিজের এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ সাইন্স এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন, তার প্রতি ইউরোপীয় বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে। রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।”

এই বক্তৃতা বিষয়ে পারসন্‌স ম্যাগাজিন লিখেছিল: ‘‘বিদেশী আক্রমণে ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বহুবছর ধরে ভারতে জ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হয়ে চলেছিল… প্রবল বাধা-বিপত্তির মধ্যে গবেষণা চালিয়ে একজন ভারতীয় অধ্যাপক আধুনিক বিজ্ঞানের জগতেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাজের নজির রেখেছেন। বিদ্যুৎরশ্মি বিষয়ে তার গবেষণাপত্র ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে পঠিত হবার সময় তা ইউরোপীয় জ্ঞানী-গুণীমহলে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তাঁর ধৈর্য ও অসাধারণ শক্তির প্রশংসা করতেই হয়- অন্ততঃ যখন ভাবি যে তিনি মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অত্যন্ত দুরূহ বিভাগের ছয়টি উল্লেখযোগ্য গবেষণা শেষ করেছেন।’’

লিভারপুলে বক্তৃতার পর তাঁর আরও সাফল্য আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ। এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে “ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স” নামে সুপরিচিত ছিল। এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন একেবারে প্রথম সারির কোন আবিষ্কারক। সে হিসেবে এটি জগদীশচন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তার এই বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস” তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি।

বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র্যা লে তার বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল”। এই বক্তৃতার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানী জেমস ডিউয়ার-এর সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। ডিউয়ার গ্যাসের তরলীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত।

এই বক্তৃতা সম্বন্ধে “স্পেক্টেটর” পত্রিকায় লিখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব।” এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Société de Physique-এর সদস্য মনোনীত হন। বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না,তিনি তা প্রমাণ করেন।

জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেন: “জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষিতুল্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছেন: “ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।”

তিনি তাঁর সফল জীবনের পথচলায় বহু সম্মাননায় ভূষিত হন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, নাইটহুড (১৯১৬), রয়েল সোসাইটির ফেলো (১৯২০), ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য (১৯২৮), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি (১৯২৭), লিগ অফ ন্যাশন্‌স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো (এর বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি)।

এছাড়াও তিনি তাঁর বিচিত্র কর্মময় জীবনে বহু গ্রন্থ লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন। বাংলা ভাষায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান “অব্যক্ত” গ্রন্থটি এবং ইংরেজিতে তিনি সম্পাদনা করেন “Responses in the Living and Non-living (১৯০২)”; “Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (১৯০৬)”; “Comparative Electrophysiology (১৯০৭)”; “Physiology of the Asent of Sap (১৯২৩)”; “Physiology of Photosynthesis (১৯২৪)”;“Nervous Mechanism of Plants (১৯২৫)”; “Collected Physical Papers (১৯২৭)”; “Growth and Tropic Movement in Plants (১৯২৯)”।

এছাড়াও তার কিছু জার্নাল প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। তাঁর মাঝে ,  Nature -published about 27 papers, Bose J.C. (1902). “On Elektromotive Wave accompanying Mechanical Disturbance in Metals in Contact with Electrolyte”. Proc. Roy. Soc. 70 (459–466): 273–294. doi:10.1098/rspl.1902.0029. Bose J.C. (1902). “Sur la réponse électrique de la matière vivante et animée soumise à une excitation — Deux procédés d’observation de la réponse de la matière vivante”. Journal de Physique. 4 (1): 481–491.

লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন সহ বিশ্বের বড় বড় সব শহর ঘুরে তিনি সেসব দেশের নাগরিকদের বিজ্ঞান সাধনার দিকে আগ্রহের ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন এবং সেসব দেশের মডেলে তিনিও ভারতে একটি সাইন্স একাডেমি খোলার প্রয়োজন ও আগ্রহ বোধ করেন এবং জীবদ্দশায়ই তা বাস্তবায়ন করে যান। বর্তমানে জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মাঝে, ‘আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু কলেজ,কলকাতা’; ‘বসু ইন্সটিটিউট,কলকাতা’ উল্লেখযোগ্য।

১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর এই জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী মৃত্যবরণ করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার “JBNSTS” বৃত্তি প্রদান আরম্ভ করে।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেহাদ   

তথ্যসূত্র:
১। A versatile genius, Frontline 21 (24), 2004.
২। Chatterjee, Santimay and Chatterjee, Enakshi, Satyendranath Bose, 2002 reprint, p. 5, National Book Trust, ISBN 81-237-0492-5
৩।Sen, A. K. (১৯৯৭)। “Sir J.C. Bose and radio science”। Microwave Symposium Digest 2 (8–13): 557–560। আইএসবিএন 0-7803-3814-6। ডিওআই:10.1109/MWSYM.1997.602854।
৪। Murshed, Md Mahbub। “Bose, (Sir) Jagadish Chandra”। Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত ১২ মার্চ ২০০৭।
৫। Mahanti, Subodh। “Acharya Jagadis Chandra Bose”। Biographies of Scientists। Vigyan Prasar, Department of Science and Technology, Government of India। সংগৃহীত ১২ মার্চ ২০০৭।
৬।Mukherji, Visvapriya, Jagadish Chandra Bose, second edition, 1994, Builders of Modern India series, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India, ISBN 81-230-0047-2.
৭। “Jagadish Chandra Bose”। FamousScientists.org। সংগৃহীত ২০১১-১২-১৭।
৮। “Pursuit and Promotion of Science : The Indian Experience”। Indian National Science Academy। সংগৃহীত ২০১৩-১০-০১।
৯। “Jagadish Chandra Bose”। People। Calcuttaweb.com। সংগৃহীত ১০ মার্চ ২০০৭।
১০।”Bose, Jagadis Chandra (BS881JC)”। A Cambridge Alumni Database। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়।
১১। Gangopadhyay, Sunil, Protham Alo, 2002 edition, p. 377, Ananda Publishers Pvt. Ltd. ISBN 81-7215-362-7
১২।”Jagadish Chandra Bose” (PDF)। Pursuit and Promotion of Science: The Indian Experience (Chapter 2)। Indian National Science Academy। ২০০১। পৃ: 22–25। সংগৃহীত ১২ মার্চ,২০০৭।
১৩। উইকিপিডিয়া

ট্যাগ:

জগদ্বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু

প্রকাশ: ০৪:০৮:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ মে ২০২০

ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: জগদীশ চন্দ্র বসু ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহ জিলার কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মসুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ভগবান চন্দ্র বসু। তিনি ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। জগদীশ চন্দ্রের জন্মের সময় তিনি ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ইতোপূর্বেই তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ভগবান চন্দ্রই এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তিতে তিনি বর্ধমান ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেছেন।

ইংরেজ সরকারের অধীনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থাকা সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র নিজের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করাননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রথম স্কুল ছিল ময়মনসিংহ জিলা স্কুল। বাংলা স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব যুক্তি ছিল। তিনি মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে এদেশীয় ছেলেমেয়েদের মাতৃভাষা আয়ত্ত করা উচিত। বাংলা স্কুলে পড়ার ব্যাপারটি জগদীশ চন্দ্রের জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও সাহায্য করেছে। এর প্রমাণ বাংলা ভাষায় রচিত জগদীশের বিজ্ঞান প্রবন্ধগুলো। ভাষার প্রতি বিশেষ মমত্ববোধ ছাড়াও ভগবান চন্দ্র চেয়েছিলেন তার পুত্র দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে মিলেমিশে মানুষ হোক এবং তার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। জগদীশচন্দ্রের পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রথম বাংলা স্কুলের অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছিল।

জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খৃষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোক। বাবার ইচ্ছা ও আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ করার উদ্দেশ্যে লন্ডনে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।

তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসু’র আনুকুল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন।

১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে জগদীশ চন্দ্র ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসেন এবং তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল জর্জ রবিনসন (প্রথম মার্কুইস অব রিপন)-এর অনুরোধে স্যার অ্যালফ্রেড ক্রফট বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করেন। কলেজের অধ্যক্ষ চার্লস হেনরি টনি এই নিয়োগের বিপক্ষে ছিলেন। এখানে যোগদানের পর বসু নানাধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। তাঁকে গবেষণার জন্য কোনরূপ সাহায্য দেয়া হতো না এবং তাঁর বেতনও ইউরোপীয় অধ্যাপকদের বেতনের অর্ধেক ছিল। এর প্রতিবাদে বসু বেতন নেওয়া বন্ধ করে দেন এবং তিন বছর অবৈতনিক ভাবেই অধ্যাপনা চালিয়ে যান। দীর্ঘকাল ধরে এই প্রতিবাদের ফলে তাঁর বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়।

প্রেসিডেন্সি কলেজে গবেষণার কোন রকম উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় ২৪ বর্গফুট (২.২ মি^২) একটি ছোট ঘরে তাঁকে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে হতো। পদে পদে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাঁর বিজ্ঞান সাধনার প্রতি আগ্রহ ভগিনী নিবেদিতাকে বিস্মিত করেছিল। কলেজে যোগ দেওয়ার এক দশকের মধ্যে তিনি বেতার গবেষণার একজন দিকপাল হিসেবে উঠে আসেন।

১৮৮৭ সালে জগদীশচন্দ্র বসুর সাথে অবলার বিয়ে হয়। অবলা ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা। বিয়ের আগে অবলা বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে চাইলেও তাকে ভর্তি হতে দেয়া হয়নি, কারণ সেখানে তখন মেয়েদের পড়ানো নিষেধ ছিল। ১৮৮২ সালে বঙ্গ সরকারের বৃত্তি নিয়ে অবলা মাদ্রাজে যান পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সেখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু করলেও অসুস্থতার কারণে আবার ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের বিয়ের সময় জগদীশচন্দ্র বসু আর্থিক কষ্টের মধ্যে ছিলেন। এর মধ্যে আবার তিনি তখন কলেজ থেকে বেতন নিতেন না। এছাড়া জগদীশের বাবার কিছু ঋণ ছিল যার কারণে তাঁর পরিবারকে পথে বসতে হয়। এর মধ্য থেকে অবলা ও জগদীশ অনেক কষ্টে বেরিয়ে আসেন এবং সব ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ হন। সব ঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কিছুদিন মাত্র বসুর পিতা-মাতা জীবিত ছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার প্রথম আঠারো মাসে জগদীশ যে সকল গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছিলেন তা লন্ডনের ‘রয়েল সোসাইটি’র জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণা পত্রগুলোর সূত্র ধরেই লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৯৬ সালের মে মাসে তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে। এই গবেষণাগুলো একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিচার করতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত ৪ ঘণ্টা শিক্ষকতার পর যেটুকু সময় পেতেন তখন তিনি এই গবেষণার কাজ করতেন। তার উপর প্রেসিডেন্সি কলেজে কোন উন্নতমানের গবেষণাগার ছিলনা, অর্থ সংকটও ছিল প্রকট। সীমিত ব্যয়ে নিজ খরচে তিনি স্থানীয় মিস্ত্রীদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে পরীক্ষণের জন্য উপকরণ প্রস্তুত করতেন। তাঁর এই গবেষণা কর্মগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করেই ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বক্তৃতা দেয়ার জন্য ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এই বক্তৃতার সাফল্যের পর তিনি বহু স্থান থেকে বক্তৃতার নিমন্ত্রণ পান। এর মধ্যে ছিল রয়েল ইন্সটিটিউশন, ফ্রান্স এবং জার্মানি। এ সকল সফল বক্তৃতা শেষে ১৮৯৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি সস্ত্রীক দেশে ফিরে এসেছিলেন।

জগদীশের আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্‌ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য হের্‌ৎস চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তা শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তাঁর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাউক্রোওয়েভ। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করে। আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মূলত এর মাধ্যমেই বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান প্রদান ঘটে থাকে।

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্‌স”। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান। জগদীশ এবং অবলা দু’জনকেই তিনি তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এই বিষয়ের উপর বিখ্যাত সাময়িকী “টাইম্‌স”-এ একটি রিপোর্ট ছাপা হয় যাতে বলা হয়, “এ বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মিলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কেমব্রিজের এম.এ. এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর অফ সাইন্স এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন, তার প্রতি ইউরোপীয় বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে। রয়্যাল সোসাইটি বিদ্যুৎরশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের গবেষণাপত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে।”

এই বক্তৃতা বিষয়ে পারসন্‌স ম্যাগাজিন লিখেছিল: ‘‘বিদেশী আক্রমণে ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বহুবছর ধরে ভারতে জ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হয়ে চলেছিল… প্রবল বাধা-বিপত্তির মধ্যে গবেষণা চালিয়ে একজন ভারতীয় অধ্যাপক আধুনিক বিজ্ঞানের জগতেও বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাজের নজির রেখেছেন। বিদ্যুৎরশ্মি বিষয়ে তার গবেষণাপত্র ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে পঠিত হবার সময় তা ইউরোপীয় জ্ঞানী-গুণীমহলে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তাঁর ধৈর্য ও অসাধারণ শক্তির প্রশংসা করতেই হয়- অন্ততঃ যখন ভাবি যে তিনি মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অত্যন্ত দুরূহ বিভাগের ছয়টি উল্লেখযোগ্য গবেষণা শেষ করেছেন।’’

লিভারপুলে বক্তৃতার পর তাঁর আরও সাফল্য আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেয়ার নিমন্ত্রণ। এই বক্তৃতাটি আনুষ্ঠানিকভাবে “ফ্রাইডে ইভনিং ডিসকোর্স” নামে সুপরিচিত ছিল। এই ডিসকোর্সগুলোতে আমন্ত্রিত হতেন একেবারে প্রথম সারির কোন আবিষ্কারক। সে হিসেবে এটি জগদীশচন্দ্রের জন্য একটি দুর্লভ সম্মাননা ছিল। ১৮৯৮ সালের জানুয়ারি ১৯ তারিখে প্রদত্ত তার এই বক্তৃতার বিষয় ছিল “অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকট্রিক রেইস” তথা বিদ্যুৎরশ্মির সমাবর্তন। এই বক্তৃতার সফলতা ছিল সবচেয়ে বেশি।

বায়ুতে উপস্থিত বেশ কিছু বিরল গ্যাসের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র্যা লে তার বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষাগুলো দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল। তিনি এ সম্পর্কে বলেছিলেন, “এমন নির্ভুল পরীক্ষা এর আগে কখনও দেখিনি- এ যেন মায়াজাল”। এই বক্তৃতার সূত্র ধরেই বিজ্ঞানী জেমস ডিউয়ার-এর সাথে জগদীশচন্দ্রের বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। ডিউয়ার গ্যাসের তরলীকরণের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত।

এই বক্তৃতা সম্বন্ধে “স্পেক্টেটর” পত্রিকায় লিখা হয়েছিল, “একজন খাঁটি বাঙালি লন্ডনে সমাগত, চমৎকৃত ইউরোপীয় বিজ্ঞানীমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য অভিনব।” এই বক্তৃতার পর ফ্রান্স এবং জার্মানি থেকে আমন্ত্রণ আসে এবং তিনি সেখানে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। সবখানেই বিশেষ প্রশংসিত হন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক কর্ন তার বন্ধু হয়ে যায় এবং তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি Société de Physique-এর সদস্য মনোনীত হন। বাঙালিরাও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিউটন-আইনস্টাইনের চেয়ে কম যায়না,তিনি তা প্রমাণ করেন।

জগদীশ চন্দ্র যে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী তার স্বীকৃতি দিয়েছিল লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা, ১৯২৭ সালে। আর আইনস্টাইন তার সম্পর্কে নিজেই বলেছেন: “জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋষিতুল্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে বলেছেন: “ভারতের কোনও বৃদ্ধ ঋষির তরুণ মূর্তি তুমি হে আর্য আচার্য জগদীশ।”

তিনি তাঁর সফল জীবনের পথচলায় বহু সম্মাননায় ভূষিত হন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, নাইটহুড (১৯১৬), রয়েল সোসাইটির ফেলো (১৯২০), ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স-এর সদস্য (১৯২৮), ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি (১৯২৭), লিগ অফ ন্যাশন্‌স কমিটি ফর ইনটেলেকচুয়াল কো-অপারেশন -এর সদস্য, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সাইন্সেস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো (এর বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সাইন্স একাডেমি)।

এছাড়াও তিনি তাঁর বিচিত্র কর্মময় জীবনে বহু গ্রন্থ লিখেছেন ও সম্পাদনা করেছেন। বাংলা ভাষায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান “অব্যক্ত” গ্রন্থটি এবং ইংরেজিতে তিনি সম্পাদনা করেন “Responses in the Living and Non-living (১৯০২)”; “Plant Responses as a Means of Physiological Investigations (১৯০৬)”; “Comparative Electrophysiology (১৯০৭)”; “Physiology of the Asent of Sap (১৯২৩)”; “Physiology of Photosynthesis (১৯২৪)”;“Nervous Mechanism of Plants (১৯২৫)”; “Collected Physical Papers (১৯২৭)”; “Growth and Tropic Movement in Plants (১৯২৯)”।

এছাড়াও তার কিছু জার্নাল প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। তাঁর মাঝে ,  Nature -published about 27 papers, Bose J.C. (1902). “On Elektromotive Wave accompanying Mechanical Disturbance in Metals in Contact with Electrolyte”. Proc. Roy. Soc. 70 (459–466): 273–294. doi:10.1098/rspl.1902.0029. Bose J.C. (1902). “Sur la réponse électrique de la matière vivante et animée soumise à une excitation — Deux procédés d’observation de la réponse de la matière vivante”. Journal de Physique. 4 (1): 481–491.

লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন সহ বিশ্বের বড় বড় সব শহর ঘুরে তিনি সেসব দেশের নাগরিকদের বিজ্ঞান সাধনার দিকে আগ্রহের ব্যাপারটি লক্ষ্য করেন এবং সেসব দেশের মডেলে তিনিও ভারতে একটি সাইন্স একাডেমি খোলার প্রয়োজন ও আগ্রহ বোধ করেন এবং জীবদ্দশায়ই তা বাস্তবায়ন করে যান। বর্তমানে জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যার মাঝে, ‘আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু কলেজ,কলকাতা’; ‘বসু ইন্সটিটিউট,কলকাতা’ উল্লেখযোগ্য।

১৯৩৭ সালের ২৩ নভেম্বর এই জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী মৃত্যবরণ করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার “JBNSTS” বৃত্তি প্রদান আরম্ভ করে।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেহাদ   

তথ্যসূত্র:
১। A versatile genius, Frontline 21 (24), 2004.
২। Chatterjee, Santimay and Chatterjee, Enakshi, Satyendranath Bose, 2002 reprint, p. 5, National Book Trust, ISBN 81-237-0492-5
৩।Sen, A. K. (১৯৯৭)। “Sir J.C. Bose and radio science”। Microwave Symposium Digest 2 (8–13): 557–560। আইএসবিএন 0-7803-3814-6। ডিওআই:10.1109/MWSYM.1997.602854।
৪। Murshed, Md Mahbub। “Bose, (Sir) Jagadish Chandra”। Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত ১২ মার্চ ২০০৭।
৫। Mahanti, Subodh। “Acharya Jagadis Chandra Bose”। Biographies of Scientists। Vigyan Prasar, Department of Science and Technology, Government of India। সংগৃহীত ১২ মার্চ ২০০৭।
৬।Mukherji, Visvapriya, Jagadish Chandra Bose, second edition, 1994, Builders of Modern India series, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India, ISBN 81-230-0047-2.
৭। “Jagadish Chandra Bose”। FamousScientists.org। সংগৃহীত ২০১১-১২-১৭।
৮। “Pursuit and Promotion of Science : The Indian Experience”। Indian National Science Academy। সংগৃহীত ২০১৩-১০-০১।
৯। “Jagadish Chandra Bose”। People। Calcuttaweb.com। সংগৃহীত ১০ মার্চ ২০০৭।
১০।”Bose, Jagadis Chandra (BS881JC)”। A Cambridge Alumni Database। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়।
১১। Gangopadhyay, Sunil, Protham Alo, 2002 edition, p. 377, Ananda Publishers Pvt. Ltd. ISBN 81-7215-362-7
১২।”Jagadish Chandra Bose” (PDF)। Pursuit and Promotion of Science: The Indian Experience (Chapter 2)। Indian National Science Academy। ২০০১। পৃ: 22–25। সংগৃহীত ১২ মার্চ,২০০৭।
১৩। উইকিপিডিয়া