ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: “সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাঁধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না।” – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
লিখাটির শুরু করলাম সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গে জাতির পিতার একটি বিখ্যাত উক্তির মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু নিজে একজন ধর্ম অন্তপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের প্রারম্ভিক কালের একটি বড় সময় ভারতে ব্রিটিশ শাসন দেখেছেন। ভারতীয় সমাজকে ব্রিটিশদের ধর্মের ভিত্তিতে “ডিভাইড এন্ড রুল” নীতি সম্পর্কেও তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন! ধর্মের অপরিণামদর্শী ব্যবহারের দরুণ সৃষ্ট কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা এবং অন্যান্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার ভয়াবহতার একজন চাক্ষুস স্বাক্ষী ছিলেন বঙ্গবন্ধু! পরবর্তীতে জীবনের মধ্য বয়সে পুরোটা ভাগ তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসন-শোষণ দেখেছেন! পাকিস্তানি আমলের ২৪ বছরে ধর্মের যথেচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবহার তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
আর এসব অভিজ্ঞতার আলোকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের যথেচ্ছ অপব্যবহার রোধের সব রকমের বন্দোবস্ত করেছিলেন! স্বাধীন দেশে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র দশ মাসের মধ্যে দেশবাসীকে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান উপহারের মাধ্যমে তিনি তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন!
কিন্তু ’৭৫ এর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আবারও স্থান করে নিতে শুরু করে! সেই ধারা আজও বন্ধ হয়নি! পরবর্তীতে সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার যে আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিলো, তার মুখে কষে চপেটাঘাত করা হয়েছে!
আমরা প্রায়শই একটি বিষয় ভুলে যাই। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ঘাটলেই আমরা দেখতে পাই, ভারত এবং পাকিস্তান -দুটো রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। হিন্দুদের মেজরিটি নিয়ে গঠিত ভারতীয় ইউনিয়ন তথা হিন্দুস্তান এবং মুসলিমদের জন্য স্বাতন্ত্র্য আবাসভূমির দাবি নিয়ে গঠিত হয়েছিলো পাকিস্তান! কিন্তু শুধুমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের আরেক উত্তরসূরী বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিলো অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম থেকে!
জন্মলগ্ন থেকে ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হিন্দুরা প্রাধান্য পাচ্ছেন, একই রকমভাবে পাকিস্তানে মুসলমানরা প্রাধান্য পাচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছিলো মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসি সর্বোপরি সর্বস্তরের মানুষজন। আর যে হাতেগোনা একটি অংশ স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিলো, তাঁরা প্রায় সকলেই ছিলেন মুসলমান, তথা ধর্ম ব্যবসায়ী! তাই বলাই বাহুল্য, এই দেশের উপর প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। এখানে কেউই হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ নন! এখানে সবার পরিচয় একটাই! আমরা সবাই বাংলাদেশী। সবার নাগরিক অধিকার সমান। কেউ কারুর চেয়ে বড় কিংবা ছোট নন। এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযুদ্ধাদের স্বপ্ন ছিলো!
বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোন পথে চলবে, তার ফয়সালা স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালী তাঁদের প্রাণ দিয়ে নির্ধারণ করে গিয়েছেন। বড়ই আফসোসের বিষয়, স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বর্ষে এসে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী গোষ্ঠী এবং তাদের উত্তরাধিকারেরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আমাদের সমাজে! ধর্মীয় বিষয়টি আমাদের সমাজে অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ইস্যু। আর এই স্পর্শকাতরতাকে কাজে লাগিয়ে উগ্র সাম্প্রদায়িকেরা সর্বত্রই তাদের ছাপ রাখতে সক্ষম হচ্ছে! ধর্মের মূল চেতনার বাইরে গিয়ে মানুষজনকে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন এই ধর্মীয় ব্যবসায়ীগণ!
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “ধর্ম যারা সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়া প্রচার করিতে চেষ্টা করে, তহারা ক্রমশই ধর্মকে জীবন হইতে দূরে ঠেলিয়া থাকে। ইহারা ধর্মকে বিশেষ গন্ডি আঁকিয়া একটা বিশেষ সীমানার মধ্যে আবদ্ধ করে।”
প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের স্বাধীনতার আজ ৫০ তম বর্ষে এসেও কেনো মানুষজন এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন? কেনো পশ্চাৎপদ হচ্ছেন? উত্তরটির ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে অনেক গভীর এবং বিস্তৃত! তবে আমার ক্ষুদ্র মস্তিস্কের উপলব্ধি থেকে বলতে পারি, এই ধর্ম ব্যবসায়ীগণ আশকারা পাচ্ছেন মূলত সমাজের কিছু নৈতিক অবক্ষয়কে কাজে লাগানোর মাধ্যমে!
মাদক, ধর্ষণ, অশ্লীলতা, ঘুষ-দুর্নীতি, তরুণদের অভদ্র ব্যবহার, গ্যাংবাজি, মারামারি-হানাহানি, স্বার্থের সংঘাত -ইত্যাদি নানা কারণেই সমাজে ধর্মব্যবসায়ীরা এখনও টিকে রয়েছেন! সমাজের প্রতিটি অবক্ষয় তাদেরকে নতুন ইস্যু তৈরীর সুযোগ এনে দেয়! কথা বলার সুযোগ করে দেয়! মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলার সুযোগ করে দেয়! আর এভাবেই তারা এখনও মানুষের মগজের ভেতর ঢুকে সমাজের প্রতিটি স্তরে জায়গা করে আছেন! এক্ষেত্রে উক্ত অপরাধ গুলোকে নস্যাৎ না করতে পারার ব্যর্থতার দায় অবশ্যই সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভুদের নিতে হবে!
কথা হচ্ছে, তাহলে ধর্ম নিয়ে কথা বলা সবাই কী খারাপ? কিংবা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে আসলেই কী ধর্মীয় নেতারা খারাপ হয়ে গেলেন? ধর্ম ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন? এর উত্তর, ‘অবশ্যই না’! আমার নিজ চোখে দেখা অনেক বক্তাই রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে, সভা গুলোতে প্রদান করা বক্তব্যের মাধ্যমে হিংসা কিংবা দ্বেষ না ছড়িয়ে অন্যদের প্রতি উদাহরণ তৈরী করছেন। নিজ ধর্ম সুষ্ঠুভাবে পালনের মাধ্যমে, নিজের সৎ আচরণের মাধ্যমে এবং নিজেদের কাজে ও কথায় তাঁরা অন্য ধর্মের মানুষদেরও আকৃষ্ট করছেন!
উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, হিংসার আগুন কিংবা গুজব ছড়িয়ে কখনোই কোনো গোষ্ঠী টিকে থাকতে পারেনি! তাই এই কথাটির মর্মার্থ আমাদের সমাজের বিবাদমান সব পক্ষকেই উপলব্ধি করতে হবে।
আমার নিজেরই অনেক হিন্দু বন্ধু রয়েছেন, অনেক খ্রিস্টান ধর্মযাজকের সঙ্গে আমার পরিচয় রয়েছে, আদিবাসী নৃগোষ্ঠী অনেকের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে! এক টেবিলে খাবার সময় কখনোই আমরা ধর্মীয় ভেদাভেদ করিনি। চায়ের কাপে আড্ডায় করা তর্কগুলো কখনোই হিংসার বাণী ছড়ায়নি। স্বীয় মতামতকে অন্যের উপর যেমন চাপিয়ে দিইনি, তাঁদের মতামতকে যুক্তিহীনভাবে গ্রহণ করিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু বক্তাগণ নৈতিক মূল্যবোধকে পাত্তা না দিয়ে, জোর পূর্বক যেভাবে নিজেদের মতামতকে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন, সেটা সমাজের জন্য যে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনছে, তার ভরপাই করতে হলেও অনেক বছর লেগে যাবে আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থার।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙন এবং কিছুদিন পর মহান বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভাঙন আমাদেরকে চোখে আঙুল তুলে সাম্প্রদায়িক ব্যবসা তথা বিষাক্ততার পরিসর বুঝিয়ে দিয়েছে! একটি হামলায় মৌলবাদীরা সরাসরি যুক্ত, অন্যটি সামাজিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ঘটানো হয়েছে! বাঙালী মুক্তি সংগ্রাম আন্দোলনের দুই কিংবদন্তী ব্যাক্তিত্বের ভাস্কর্য ভাঙার মধ্য দিয়ে সর্বোপরি স্বাধীনতার অস্তিত্বের উপরই হামলা করা হয়েছে। আর এই ইস্যু গুলোকে বাড়তে দিয়েছে এই ধর্ম ব্যবসায়ীগণই।
আমি আমার অপরিণত মস্তিস্কের এ যাবতকালীন লব্ধ জ্ঞান থেকে বলতে পারি, আমার ধর্ম আমার কাছে এবং আপনার ধর্ম আপনার কাছে। স্বীয় ধর্মকে সযত্নে লালন পালনের মাধ্যমে অন্য ধর্মকে সম্মান জানানোর মাঝেই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা। আমার কাছে আমার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। আপনার কাছে আপনার ধর্ম শ্রেষ্ঠ। এই কথাটিকে স্বীকৃতি প্রদানের নামই ধর্ম নিরপেক্ষতা। কিন্তু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে প্রত্যেক ধর্মেই কিছু ব্যবসায়ী মাথা রয়েছেন। তাঁরা সবসময়ই নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের তাগিদে অন্য ধর্মকে হেয় করার, জঘন্য ভাষায় আক্রমণে করার রাস্তা বেছে নেন। আর তখনই সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ততা সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। সৃষ্টি হয় হানাহানির।
তাই আমাদেরকে এখনই সচেতন হতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার এই বিষাক্ত কড়াল গ্রাস থেকে মুক্ত না হতে পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ তৈরী করতে হবে।
লিখা প্রসঙ্গেই আমাদের সমাজের আরও একটি ভয়াবহ দিক নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়! আমাদের সমাজের একটি শিক্ষিত অংশ, ক্রমশই ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, অসাম্প্রদায়িকতার নামে সম্প্রদায়হীন হয়ে পড়ছেন! এরা সমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারিগর। এই সম্প্রদায়হীন অসাম্প্রদায়িক অংশটাই সমাজে ধর্ম ব্যবসায়ীদেরকে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ করে দিচ্ছেন।
ধর্ম কখনোই কোনো প্রকারের হানাহানি কিংবা হিংসা-বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেয়না! সব ধর্মের মূল বাণী শান্তির প্রচার। আজকের লিখাটির প্রধান উদ্দেশ্যও শান্তির এই বাণীটিই পাঠক সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার।
আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা জন্মগত ভাবে একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা আরও কঠিন। তাই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধাগণ, স্বাধীনতা সংগ্রামীগণ দেশের জন্য যা করে গিয়েছেন, আমাদের দায়িত্ব তারচেয়ে ঢের বেশি!
স্বাধীনতার ৫০ তম বছরে এসে কাঙ্খিত উন্নয়ন, ভবিষ্যত প্রত্যাশা, সমৃদ্ধ অর্থনীতি, যুগোপযোগী আইসিটি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা না হয়ে সর্বত্র সাম্প্রদায়িক বিষবার্তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে! একটা জাতির জন্য এরচেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে!
সম্প্রতি কিছু ক্যালকুলেশনে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ১৯৭১ এর সঙ্গে ২০২১ এর ক্যালেন্ডার হুবহু মিলে যাচ্ছে। ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন তরুণ সেনানীরা অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছিলো। আমি বর্তমান তরুণ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে শুধু এটুকুই বলতে চাই, আমাদের সমাজকে আবারও একটি ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধে জড়াতে হবে। সকল রকমের মতবিভেদকে দূরে ঠেলে দিয়ে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে জড়াতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধে জড়াতে হবে। আর যখন সকলেরই কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক সুরক্ষা থাকবে, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা থাকবে, শিক্ষার অধিকার থাকবে, খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত হবে, কথা বলার অধিকার থাকবে, পরিকল্পিত নগর থাকবে, তখন ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোও আপনাআপনি বাস্তবায়িত হবে সবার মাঝে। সমাজে শান্তির বার্তা যেমন বইবে, সামাজিক উগ্রতাকেও রোধ করা যাবে, সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতাও বজায় থাকবে। সর্বোপরি, ধর্মকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ধর্মকে কলুষিত করা যাবেনা।