নওশীন নাওয়ার রাফা: পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মানব সভ্যতার বর্তমান উৎকর্ষ ও বিকাশের পেছনে রয়েছে অতীতের হাজারো জাতিগোষ্ঠীর কঠিন ও কঠোর তপস্যা। বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আদিকাল থেকে অদ্যবধি টিকে রয়েছে বিশ্ব সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন! চীনের মহাপ্রাচীর, মেক্সিকোর চিচেন ইৎজা, ইতালির কলোসিয়াম, পেরুর মাচু-পিচু, আগ্রার তাজমহল, এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস, তুরস্কের হায়া-সোফিয়া কিংবা মিশরের পিরামিড- সবই স্থাপত্য সভ্যতার কালজয়ী নিদর্শন! আমাদের মনে আজও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এসব অসাধারণ স্থাপত্য ও নিপুণ শিল্পকর্ম। বস্তুত, উপরোল্লিখিত প্রতিটি নিদর্শনই শিল্পকলার ইতিহাসে অমর ও কিংবদন্তী তূল্য। তথাপি, আজকের আলোচনাটি মূলত মিশরের বিখ্যাত পিরামিডের ক্রমবিবর্তন সংক্রান্ত।
প্রথমেই শুরু করি, পিরামিড কী? -এর ব্যাখ্যা দিয়ে! পিরামিড মূলত এক ধরনের ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক নকশা। এই নকশার ভূমি একটি বহুভুজাকৃতির ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রের প্রতিটি বাহু থেকে ত্রিভুজাকার ক্ষেত্র ওপরের দিকে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। এর ফলে যে ত্রিমাত্রিক অবয়ব তৈরি হয়, তাকেই বলা হয় পিরামিড। পিরামিডের এই নকশার ধারণা গণিতশাস্ত্রে প্রবেশ করেছে প্রাচীন মিসরের স্থাপনা অনুসরণে। তবে, পিরামিড বলতে জ্যামিতিক নকশার চেয়ে অধিকতর প্রাধান্য পায় মিসরের পিরামিড নামের স্থাপত্য। প্রাচীন মিসরের ফারাও রাজাদের সমাধির ওপর নির্মিত ত্রিভুজাকার স্থাপত্যকর্মই সাধারণভাবে পিরামিড নামে পরিচিত।
পিরামিড ধারণার উদ্ভব ও ব্যবহার নিয়েও প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন গল্প! মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান- মানবদেহের মমিকরন এবং পিরামিড স্থাপত্য। মিশরের চিন্তা-চেতনা মূলত আবর্তিত হয়েছে মৃত্যুর পরবর্তী জীবন রহস্যকে কেন্দ্র করে। মিসরবাসী মনে করত, মানুষ মারা যাওয়ার পর তাদের দেহ নষ্ট হলেও আত্মা বেঁচে থাকে। মৃত্যুর পর দেহ অক্ষুণ্ন থাকলে আত্মা সে দেহে আবার ফিরে আসবে, এমনটাই তারা বিশ্বাস করতো। ফলে তারা মৃতদেহকে মমি বানিয়ে পিরামিডের ভেতরে রাখতো। সাধারণ মানুষের জন্য এটি ব্যয়বহুল হলেও অভিজাতদের জন্য তা ছিলো সহজলভ্য। সম্রাটদের মৃতদেহের সঙ্গে তাঁদের ব্যবহার্য মূল্যবান সামগ্রীও পিরামিডের ভেতরের সুনির্দিষ্ট কক্ষে রাখা হতো।
অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন, প্রথম পিরামিড তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৫০০০ বছর আগে। পিরামিড স্থাপত্যশৈলী নির্মাণের পূর্বে মিশরে এক ধরনের সমাধি সৌধের কথা জানা যায়, যেগুলো আরবি ‘মাস্তাবা’ অর্থাৎ বেঞ্চ নামে পরিচিত। এ ক্ষেত্রে মাটির তলায় থাকতো কবর, আর মাটির উপরে কাদামাটির ইটের সৌধ বানানো হতো। তবে পরবর্তীতে এর আকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটেছিলো এবং পিরামিডের উদ্ভব ঘটে। সেটাই নিচে উল্লেখ করা হলো:
স্টেপ পিরামিড: তৎকালীন মিশরের সম্রাট জোসার এবং তাঁর স্থাপতি ইমহোটেপ প্রথম প্রচলিত মাস্তাবার গঠনে পরিবর্তন নিয়ে আসেন। ইমহোটেপ ছিলেন একজন বিখ্যাত সৌধ নির্মাতা। তাঁর খ্যাতি সামগ্র মিশর তথা গ্ৰিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ইমহোটেপ ‘সাকারায়’ একটি বিশাল সমাধি-সৌধ নির্মাণের সময় সেখানে উপর-নীচ করে ক্রমান্বয়ে তিনটি মাস্তাবা নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে এই সৌধের কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে ৬ টি মাস্তাবা বা ধাপ যুক্ত একটি স্থাপত্যে পরিণত করেন। এই ধাপগুলো দেখতে অনেকটা সিঁড়ির মতো বলে একে ‘সিঁড়ি পিরামিড’ বা স্টেপ পিরামিড বলা হয়। আবার, অনেকগুলো ধাপের সমন্বয়ে এই পিরামিড গঠিত হয় বলে একে ধাপ পিরামিডও বলা হতো।
এর উচ্চতা ছিলো ৬০ মিটার এবং ভিতরের আয়তন ছিলো ১৪০ ×১১৮ মিটার। এর ভেতরে আরও কয়েকটি স্থাপত্য ও মন্দিরের পাশাপাশি জোসারের স্ত্রী ও পুত্রদের সমাধিও নির্মিত হয়েছিলো। স্টেপ পিরামিড নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণ ইটের পরিবর্তে চুনাপাথরের প্রয়োগ দেখা যায়।
প্রকৃত পিরামিড: সমাধি নির্মাণের ক্ষেত্রে স্টেপ পিরামিডের মাধ্যমে বহু পরিবর্তন ঘটানোর পর স্নেফেরুর শাসনকাল থেকে মিশরে প্রকৃত পিরামিড নির্মাণ হয়। এধরনের পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ মেইদামে পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রেও চুনাপাথরের ব্যবহার ঘটলেও সেগুলো মূলত শৌখিনতা বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হয়েছিলো। এই পিরামিডের উচ্চতা ৯৩.৫ মিটার এবং তলদেশে ১৪৭ মিটার লম্বা।
রেড পিরামিড ও বেন্ট পিরামিড: মিশররাজ স্নেফেরূর তৈরি পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ ছিলো- রেড পিরামিড। বর্তমান কায়রোর ৪০ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত দহশুর নামক স্থান থেকে এই পিরামিড নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে। এখানে রাজার সমিধি ছিলো। এছাড়া, দহশুর থেকেই আবিস্কৃত হয়েছে বেন্ট পিরামিড। নরম বাড়ি মাটির উপর এই পিরামিড নির্মাণের জন্য এটি ঝুঁকে পড়েছিলো। ফলে উচ্চতা কমানোর জন্য বাইরের কৌণিক মাপ ৫৪ কোন থেকে ৪৩ কোণে নামিয়ে আনা হয়েছিলো। মূলত, ঝুঁকে পড়ার জন্যই এই পিরামিডকে বেন্ট পিরামিড বলা হতো।
গ্রেট পিরামিড: মিশররাজ খুফুর সময়কালে মিশরের সবচেয়ে বৃহত্তম পিরামিড নির্মিত হয়েছিলো। খুফুর কায়রোর পশ্চিমে গির্জা মালভূমির উপর এক বৃহদাকার পিরামিড নির্মান করেন। এই পিরামিডই ‘গ্ৰেট পিরামিড’ নামে পরিচিত। এই পিরামিড নির্মাণে ২৫ লক্ষ কিউবিক মিটার পাথর ব্যবহৃত হয়েছিলো। এক্ষেত্রে চুনাপাথরের পরিমাণ ছিলো ২.৩ মিলিয়ন। এই পিরামিডের উচ্চতা ছিলো -১৪৬.৬ মিটার এবং তলদেশ ২৩০ মিটার লম্বা। মোট ৫.৩ হেক্টর জায়গা জুড়ে ছিলো এই পিরামিডের অবস্থান।
পরবর্তীকালে আরও বহু পিরামিড নির্মিত হয়েছিলো। খুফুর ছেলে জেদাফরে গিজার উত্তর দিকে একটি পিরামিড তৈরি করেছেন। তার পরবর্তী শাসক কেপলরেন ও দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিড নির্মাণ করেন যার উচ্চতা ১৪৩.৫ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ২১৫ মিটার। এছাড়াও, ফ্যারাও মেনকাওরা ৬৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি পিরামিড নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে খননকার্যের মাধ্যমে গিজার মালভূমিতে পাহাড় কেটে তৈরি যাবার উপর ভর করা একটি সিংহ মূর্তিও আবিষ্কৃত হয়েছে, যার উচ্চতা ১৭০ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১৫০ ফুট।
২০০৮ সাল অবধি মিসরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩৮টি পিরামিড পাওয়া গেছে। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবেও খ্যাতি পায় গিজার পিরামিড। এই পিরামিডগুলোর বেশির ভাগই রাজধানী কায়রোর কাছে। মূল গর্ভগৃহ ছাড়াও পিরামিডের একাধিক কক্ষ থাকতো এবং অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য গোপন পথও ছিলো। প্রাথমিক পর্বে পিরামিড নির্মাণের যে রীতি ও গঠন প্রচলিত ছিলো, পরবর্তীকালে বিভিন্ন মিশরীয় রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় তা পরিণত ও বৃহত্তর রূপ লাভ করে।
পরিশেষে, পিরামিডের স্থাপত্যগত জটিলতার জন্য সম্পূর্ণ স্থাপত্যের পরিকল্পনা কখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। আজ অবধি বহু প্রাণ পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য হয়েছে শুধুমাত্র পিরামিড রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে! পর্যটন খাতে ক্ষতির আশঙ্কা থেকে মিশরের সরকারও কখনো চায়নি পিরামিড রহস্যের অবসান হোক! এক্ষেত্রে, আধুনিক প্রযুক্তিও যেনো অন্ধকারে পতিত! বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিবেচনা করেই আমরাও চাই, পৃথিবীর বুকে অনন্তকাল টিকে থাকুক প্রাচীন সভ্যতার এই অমূল্য সম্ভার!
লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়