নওশীন নাওয়ার রাফা: চিত্রকলার অন্যতম এক নান্দনিক ও আকর্ষণীয় শাখা রিকশাচিত্র। সাধারণত রিকশার পেছনে, হুডে কিংবা ছোট-ছোট অনুষঙ্গে এই বিশেষ চিত্রকর্ম লক্ষ্য করা যায়। সহজভাবে বলতে গেলে, রিকশায় উজ্জ্বল রঙে আঁকা কিছু চিত্রকে রিকশাচিত্র বলে। এই চিত্র খুব সাবলীল ভঙ্গিতে যে কোনো বিষয়বস্তুকে উপস্থাপন করতে সক্ষম।
বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের চিত্রকলাকে ফোক আর্ট, পপ আর্ট কিংবা ক্র্যাফট সব দিক দিয়েই আলোচনা করতে পছন্দ করেন। তাদের মতে, যে কোনো বস্তুরই ‘ফর্ম’ আর ‘ডেকোরেশন’ নামে দুটি দিক থাকলেও, রিকশাচিত্র কেবলই এক প্রকার ‘ডেকোরেশন’।
চিত্রকরদের মতে, রিকশাচিত্রের টান বা আঁচড়গুলো খুবই সাবলীল, প্রাণবন্ত ও স্পষ্ট এবং ছোট ও নিখুঁত হয়। অথচ, এই বিশেষ চিত্রকলার জন্য নেই কোনো আলাদা প্র্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। একেবারেই দেশজ কুটির শিল্পের মতো শিল্পীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে শিখে থাকেন এই চিত্রশিল্প এবং নিজের কল্পনা থেকেই এঁকে থাকেন এগুলো।
রিকশাচিত্র, রিকশা আর্ট কিংবা ত্রিচক্র-যান-চিত্র বাংলাদেশের নব্য-রোমান্টিকতার মধ্যে আবির্ভূত একটি শিল্প ধারা। এই শিল্পকে বহমান ঐতিহ্য বা লিভিং ট্রেডিশনও বলা হয়। এই ধরনের চিত্রকর্ম ভারতের কিছু জায়গায়ও দেখা যায়। রিকশা চিত্রের মূল লক্ষ্য রিকশাকে সুসজ্জিত ও যাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় করা।
সাধারণত শিল্পীরা মহাজন এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী রিকশায় চিত্র এঁকে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এনামেল পেইন্ট দিয়েই তারা আঁকেন। রাজধানীর বকশীবাজার, বেড়িবাঁধ, মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানসহ বেশ কয়েক জায়গায় রয়েছেন এমন শিল্পী। তারা নতুন রিকশা যেমন পেইন্ট করেন, তেমনি পুরনো রিকশাও ঘষেমেজে পেইন্ট করে দেন। তবে গত ৫০ বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে রিকশা পেইন্টিং করা হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম ভারতের সিমলায় ১৮৮০ সালের দিকে রিকশার প্রচলন হয়। ১৯৩০ সালে প্রচলন শুরু কলকাতায়। এরই কোন এক কাছাকাছি সময়ে ১৯৩০ এর দশকের শেষভাগে ঢাকার সূত্রাপুর ও ওয়ারী এলাকায়, ময়মনসিংহ এবং নারায়ণগঞ্জে বাহন হিসেবে রিকশার ব্যবহার শুরু হয়। তবে তখন ছিল মানুষে টানা রিকশার যুগ। ১৯৪৭ -এর দেশভাগের পর ঢাকাসহ দেশের অন্য শহরগুলোতে সাইকেল রিকশা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। তখন থেকেই রিকশা পেইন্টিংয়ের শুরু।
দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক চারুকলার ধারার পাশাপাশি একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক ধারাও গড়ে ওঠে। এর নেতৃত্ব দেন পীতলরাম সুর, আর কে দাস, আলাউদ্দিন, আলী নুর, দাউদ উস্তাদ প্রমুখ শিল্পী। তাঁদের হাত ধরে বিকশিত হয় এ দেশের সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, রিকশা আর্ট, ট্রাক আর্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে নিজস্ব শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বিষয়বস্তুর স্বকীয়তায় দেশে-বিদেশে সুধীজনের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে রিকশা আর্ট।
বাংলাদেশে রিকশাচিত্র ১৯৫০-এর দশক থেকে প্রচলিত এবং রিকশার প্রায় সম্ভাব্য সব অংশই চিত্রিত করার একটা প্রয়াস লক্ষ করা যেতো। জ্যামিতিক নকশার পাশাপাশি ফুল, পাখি এমনকি জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের ছবি আঁকারও প্রচলন ছিল। কখনো রিকশাচিত্রে রিকশাওয়ালার ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলিত হতো, আবার কখনো হয়তো নিছক কোনো বক্তব্য কিংবা সামাজিক কোনো বিষয় দেখা যেতো।
ষাটের দশকে রিকশা পেইন্টিং করা হতো মূলত শীর্ষস্থানীয় চলচ্চিত্র তারকাদের প্রতিকৃতি অবলম্বনে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি রিকশায় মানুষের ছবি আঁকার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হলে রিকশা পেইন্টাররা মানুষের পরিবর্তে পশুপাখির ছবি আঁকতে শুরু করেন। যেমন, ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে একটা শিয়াল, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটা বাঘ, পাশে স্কুল বালকের মতো ব্যাগ কাঁধে খরগোশ ছানা চলেছে স্কুলে।
এ ছাড়া বিভিন্ন মিথ বা ধর্মীয় কিংবদন্তিকে বিষয় করে রিকশায় ছবি আঁকা হয়। যেমন, মুসলম উপাখ্যানের দুলদুল, মিরাজ গমনের বাহন বোরাক কিংবা আরব্য রজনীর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ও দৈত্য, রাজকন্যা, রাজপ্রসাদ ইত্যাদি।
‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাদায় আটকে যাওয়া গরুর গাড়ির ছবিটি রিকশাচিত্রীরা বিভিন্নভাবে এঁকেছেন। ভিনদেশি দৃশ্য যেমন, মরুভূমির ভেতর উট নিয়ে চলেছে দুই বেদুইন কিংবা অচেনা কোনো সমুদ্র সৈকতে খেলা করছে কোনো বালক, জাপানের কোনো বাড়ি, লন্ডন ব্রিজ, আইফেল টাওয়ার, টাইটানিক জাহাজ ইত্যাদিও রিকশাচিত্রে উঠে এসেছে। স্মৃতিসৌধ, সংসদ ভবন, শহীদ মিনার ইত্যাদি স্থাপত্য রিকশাচিত্রের বিষয় হয়েছে বহুবার। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন তাজমহল রিকশা পেইন্টিংয়ের আরেকটি জনপ্রিয় বিষয়। ইদানীং রিকশাচিত্রীদের আরেকটি প্রিয় বিষয় বঙ্গবন্ধু সেতু।
এ ছাড়া ডাইনোসরের সঙ্গে যুদ্ধরত লুঙ্গিপরা খালি গায়ের বাঙালি- রিকশাচিত্রীদের অপূর্ব কল্পনা শক্তির নিদর্শন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিষয়বস্তু করে রিকশা চিত্রে উঠে এসেছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ, বাংলাদেশি নারী-পুরুষদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ, বিজয় উদযাপন ইত্যাদি।
আবার সত্তরের দশকে নতুন দেশের নতুন রাজধানী হিসেবে ঢাকা যখন বাড়তে শুরু করে, তখন কাল্পনিক শহরের দৃশ্য আঁকা হতো রিকশায়। পাশাপাশি সব সময়ই গ্রামের জনজীবন, প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিও আঁকা হতো, এখনো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন স্টাইলের ফুল, পাখি ইত্যাদি তো আছেই।
ইদানীং রিকশা পেইন্টারদের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধারার শিল্পীদের যৌথ আর্ট ওয়ার্কশপের সংবাদও জানা যায়। আবার কোনো-কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধারার শিল্পীর কাজে রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। ১৯৮৮ সালে লন্ডনে মিউজিয়াম অব ম্যানকাইন্ডে (বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অন্তর্ভুক্ত) শিরিন আকবরের কিউরেটিংয়ে ঢাকার রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘ট্রাফিক আর্ট: রিকশা পেইন্টিং ফ্রম বাংলাদেশ’। ব্রিটিশ মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের সুসজ্জিত ও চিত্রিত রিকশা সংগৃহীত আছে। জাপানের ফুকুয়োকা এশিয়ান আর্ট মিউজিয়ামেও বাংলাদেশের রিকশা পেইন্টিং নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হয়েছে এবং এই মিউজিয়ামে রিকশা পেইন্টিংয়ের একটা বড় সংগ্রহ আছে।
২০১৩ জাপানের তাকামাতসু শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালে বাংলাদেশের রিকশাচিত্র বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে। নেপালেও হয়েছে বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী। তবে বাংলাদেশে রিকশা পেইন্টিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনীটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। এ প্রদর্শনীতে ৫০০ জন রিকশা পেইন্টার এবং ৮৩ জন বেবিট্যাক্সি (দুই স্ট্রোকবিশিষ্ট অটোরিকশা) পেইন্টারের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছিল।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ইদানীং ঢাকার রিকশা চিত্রশিল্পী, যারা এখনো সক্রিয়, তারা মূলত বিদেশি ক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল। বিদেশীদের শখ মেটানো গেলেও, তাতে রিকশাচিত্রীদের জীবনে, দু-একটি বিরল ব্যতিক্রম বাদে, বিশেষ কোনো হেরফের হয়েছে এমনটা মনে হয় না। বরং হাতে আঁকা প্লেটের বিকল্প হিসেবে ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় এই বিশেষ রীতির চিত্রকলা আজ হুমকির সম্মুখীন। পেশাগত দিক দিয়ে হুমকির সম্মুখীন রিকশা পেইন্টাররা।
ইতোমধ্যে বেশির ভাগ রিকশা চিত্রশিল্পী পেশা পরিবর্তন করেছেন বা বিকল্প কাজ খুঁজে নিয়েছেন। ঢাকায় বর্তমানে আনুমানিক ৮-১০ জন সক্রিয় রিকশা চিত্রশিল্পী আছেন। ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, খুলনা, পাবনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ইত্যাদি শহরে আরো কিছু রিকশা চিত্রশিল্পী কমবেশি কাজ করেন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রিকশা দেখা গেলেও, রিকশা এবং রিকশা চিত্রকে ঐতিহ্যের পর্যায়ে নিয়ে গেছে বাংলাদেশই। তাই এখানে, রিকশা পেইন্টিংয়ের প্রাতিষ্ঠানিক গুরুত্বও ব্যাপক। চিত্রকলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার এই রিকশাচিত্র। এছাড়া, রিকশাচিত্রে লোকায়ত ধারার প্রভাবও লক্ষণীয়। বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর চারুশিল্পের ইতিহাসেও বিশেষ ধরন বা শৈলী হিসেবে রিকশা পেইন্টিং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারার বিলুপ্তি ঘটলে পৃথিবীর শিল্পকলার ইতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য শৈলীর অবসান ঘটবে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।
আশার কথা, সম্প্রতি বাংলাদেশে রিকশাচিত্র নিয়ে কিছু উদ্যোগের খবর জানা যাচ্ছে। ‘রিকশা পেইন্ট’ এরকমই একটি উদ্যোগ। এর লক্ষ্য রিকশাচিত্রের সঙ্গে জড়িত শিল্পীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে, তাদেরকে তাদের যথাযথ স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রিকশা চিত্রের শিল্পী ও ক্রেতাদের এক করে দেওয়া। উচ্চমানের রিকশা চিত্র তৈরি, ক্রেতার চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী চিত্রকর্ম তৈরি ও সরবরাহ এবং দেশের শিল্পকলার এই খাতটিকে পরিচিতি দানই এই প্ল্যাটফর্মটির উদ্দেশ্য।
এছাড়াও, বিভিন্ন জাদুঘরে রিকশাচিত্র সংরক্ষণ করা যেতে পারে, যেনো কালের পরিক্রমায় একেবারে হারিয়ে না যায় এটি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, গোটা লেখনীটির তথ্যসূত্র হিসেবে বিভিন্ন সময়ে রিকশা চিত্র সম্পর্কে প্রথম আলো, রোয়ার মিডিয়া, সোনালি নিউজে ছাপা লেখনীর তথ্যাবলী এবং নিজস্ব অনুধাবন তুলে ধরা হয়েছে।
পরিশেষে, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র হলেও ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর এক দেশ। আমাদের নিজস্ব পরিচয়, সাহিত্য, চেতনা, শিল্পকলা ও ইতিহাস রয়েছে। রিকশা চিত্র আমাদের এমনই এক ঐতিহ্য। স্বীয় ঐতিহ্য ও ইতিহাস ভুলে, নিজের শেকড় ভুলে পৃথিবীর কোন জাতিই উন্নতি করতে পারেনি। তাই আমাদেরও উচিত নিজেদের অস্তিত্ব স্বমহিমায় টিকিয়ে রাখতে রিকশা চিত্রের মতো বিদ্যমান সকল শিল্পকর্ম তথা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুণমান সমৃদ্ধ উপাদানসমূহ রক্ষণাবেক্ষনে মনযোগ দেয়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়