১০:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রোমান প্যানথিয়নের স্থাপত্যশৈলী

নওশীন নাওয়ার রাফা: বিশ্ব ইতিহাসেরই এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় প্রাচীন রোমান সভ্যতা। শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং গৌরব ও গরীমায় রোমান সভ্যতা বর্তমান পৃথিবীর কাছেও এক বিস্ময় জাগানিয়া নাম! বিশেষ করে, স্থাপত্য শিল্পে রোমানরা যে অগ্রগতি সাধন করেছিলো, তার নিদর্শন আজও বিশ্বের বুকে সমুজ্জ্বল রয়েছে স্বমহিমায়! এর মাঝে যে কাঠামোটি আজও সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় প্রায় ২০০০ বছর যাবত বিশ্ব বুকে টিকে রয়েছে কিংবা সংরক্ষণ করা হয়েছে, তার নাম প্যানথিয়ন।

বর্তমানে এটি মূলত একটি খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই স্থাপনাটিকে প্রাচীন রোমান মন্দির হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে, এর পরিচিতি যা-ই হোক না কেনো, কিংবা এর নির্মাতা, নির্মাণ কাল কিংবা অবস্থান -সবকিছু বর্ণনা ও আলোচনার পূর্বে এটি বলে রাখা আবশ্যক যে, প্যানথিয়ন একটি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিল্প। পৃথিবীর আশ্চর্য হিসেবে মিশরের পিরামিড যেমন হাজারো বছর ধরে আজও অক্ষত রয়েছে, প্যানথিয়নও সমান আকর্ষণ ও বিস্ময় নিয়ে আমার বিমোহিত করে চলেছে! বরং, স্থাপত্য তুলনায় কোন কোনো অংশে পিরামিডের চেয়েও প্যানথিয়ন অনন্য, কেননা, প্যানথিয়নের উপরে গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ বিদ্যমান। তাই বলা যায়, নির্মাণশৈলী এবং কারুকার্যে প্রাচীন রোমান মন্দির প্যানথিয়ন দৃষ্টি জুড়ানো এক নিদর্শন।

আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, প্যানথিয়ন মূলত একটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টপূর্বাব্দে ২৭-২৫ সনে প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাসের জামাতা মার্কাস ভিপসিনিয়াস আগ্রিপ্পার অধীনে এটি নির্মিত হয়। বর্তমানে ইতালির রোমে স্থাপনাটি অবস্থিত। বিশ্বের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র এটি।

প্রাচীন রোমান বিশ্বাস মতে, স্বর্গের ১২ দেবতার আবাসস্থল তথা চারণভূমি ছিলো এই চার্চটি। তাই মন্দিরটি দেবতাদের প্রতিই উৎসর্গীকৃত ছিল। মূল কাঠামোর নাম গ্রীক শব্দ ‘প্যান’ থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ ‘সমস্ত’ এবং ‘থিওস’ অর্থ ‘দেবতা’।

তবে, খ্রিস্টাব্দ ৪০ সালে আগ্রিপ্পার কাঠামোটি আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সম্রাট ডোমিশিয়ান এর সময়কালে খ্রিস্টাব্দ ১১০ সালে ভবনটি আবারও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে আমরা যে প্যানথিয়ন স্থাপনাটি দেখতে পাই, তা ১১৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের নেতৃত্বে পুনর্নির্মাণ করা হয়। তিনি আগ্রিপ্পার মূল ভবনের কাঠামোটি বহাল রাখেন।

ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা দেখতে পাই, প্যানথিয়নের নকশা সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে অসংখ্য ভবনকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু, প্যানথিয়নের মূল স্থপতির পরিচয় আজও অজানাই রয়ে গিয়েছে। তবে, বেশিরভাগ ইতিহাসবেত্তাই দামাস্কাসের বিখ্যাত স্থপতি অ্যাপোলোডোরসকে এই স্বীকৃতি দেন।

হ্যাড্রিয়ানের প্যানথিয়নের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ। বিশ্বের বুকে যেসব স্থাপনা আজও মাথা উঁচু করে কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে টিকে আছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই ছাদ স্তূপবিশিষ্ট কিংবা সমতল। অথচ, গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ নিয়ে প্যানথিয়ন আজও যেভাবে টিকে রয়েছে, তা সত্যিই অনন্য!

এর গম্বুজের ব্যস প্রায় ৪৩.৩০ মিটার, যা অসাধারণ! কেননা, স্থাপত্য শিল্পের ভাষায় এত বড় ডায়ামিটারের ব্যস তৈরীর জন্যে গম্বুজটির খুবই মোটা ও পুরো কাঠামো প্রয়োজন, যা একই সাথে ওজনেও কম হতে হবে, যেনো গ্র্যাভিটির টানে তা ভেঙ্গে না পড়ে! শুধু তাই নয়! স্থাপনাটিকে আরও শৈল্পিক করে তুলতে কাঠামোর মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতাও দেয়া হয়েছিলো ৪৩.৩০ মিটার (১৪২ ফুট) ।

পাশাপাশি এতে কোনো জানালা ব্যবহৃত হয়নি। জানালার পরিবর্তে গোটা কাঠামো জুড়ে দেয়ালের উপর দিকে ছোট কিছু এবং গম্বুজের মাঝে একটি ছিদ্র করা হয়েছিলো, যা দিয়ে সূর্যালোক ভেতরে প্রবেশ করে! স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞানও যাদের রয়েছে, তারাই অনুধাবন করতে পারবেন, বিষয়টি কতকটা মায়াজাল তৈরীর মতো! কেননা, সূর্য দিনের একেক সময়ে একেক অংশে অবস্থান করবে! ফলে, ভেতরে প্রবেশ করা সূর্যালোক ইন্দ্রজালের ন্যায় রহস্যঘন দেখাবে।

তাছাড়া, এই মন্দিরের সম্মুখভাগে যে পিলারগুলো রয়েছে, সেগুলোও অতুলনীয়। এতবছর যাবত কাঠামোটির ভার বয়ে চলেছে পিলারগুলো। অথচ গম্বুজটি পিলারবিহীন। ভাবতে অবাক লাগে, এত সূক্ষ্ম স্থাপত্যশিল্প, যা বর্তমানের জন্যেও চ্যালেঞ্জিং, তা প্রায় ২০০০ বছর আগে কীভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন প্রাচীন রোমান কারিগরেরা! যদিও, অনেকে ধর্মাবলম্বীই মনে করেন, ভবনটি স্বয়ং ঈশ্বর রক্ষা করছেন।

প্যানথিয়নের নির্মাণশৈলীতে গ্রীক এবং রোমান উভয় ধারার প্রভাবই দেখতে পাওয়া যায়। প্যানথিনের গম্বুজটি প্রাচীনকালের বৃহত্তম জীবিত গম্বুজ, যা এককালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গম্বুজের মর্যাদার অধিকারী ছিলো। গম্বুজের পুরুত্ব ৬.৮ মিটার (২১ ফুট)। মূল ভবনে প্রবেশের পরই দর্শনার্থীগণ একটি বিশালাকার বৃত্তাকার কক্ষ আবিস্কার করবেন। গম্বুজের শীর্ষে অবস্থিত অকুলাসটি নির্মাণকাল হতে আজ অবধি কখনোই আচ্ছাদিত ছিলো না, ফলে বৃষ্টিপাত হলে তা ভবনের ভেতরে পতিত হয়। তাই, জল নিস্কাশনের জন্য ভেতরেই একটি ড্রেন (প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বা ১২ ইঞ্চি) দিয়ে সজ্জিত তল রয়েছে। ভবনের চারপাশে থাকা সূর্যালোক প্রবেশের ছিদ্রগুলো শীতলকরণ এবং বায়ু চলাচলের জন্যেও কাজ করে। তাছাড়া, গোটা ভবনটি কংক্রিটের তৈরী। প্যানথিয়নের সামনের পিলারগুলো মূলত করিন্থিয়ান ধাচের কলাম (৮টি বৃহৎ গ্রানাইট)।

যদিও প্যানথিয়ন হাজারো বছর ধরে স্বীয় মহিমায় টিকে রয়েছে, কিন্তু, এর নির্মাণ শৈলীর প্রকৃত রহস্য আজও অনুদ্ঘাটিত। কীভাবে দু হাজারেরও বেশি সময় পূর্বের স্থপতিগণ বর্তমানের মতো স্ট্রাকচার তৈরী করতে সমর্থ হলেন, সেটিও এক মহাবিস্ময়! তবে, এটি বলা যায় যে, প্যানথিয়ন এক নিখুঁত জ্যামিতিক ভবন।

খ্রিস্টান গীর্জায় পরিণত হওয়ার পর প্যানথিয়ন রেনেসাঁ যুগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে, বিখ্যাত অনেক রেনেসাঁ কারিগর, যেমন: চিত্রশিল্পী রাফেল, সুরকার আর্কাঞ্জেলো কোরেলি এবং স্থপতি বালদাসার পেরুজিসহ প্রভূত রেনেসাঁ শিল্পীদের ব্যক্তিত্বদের সমাধিস্থল হয়ে ওঠে স্থাপনাটি। বেশ কয়েকজন রাজা ও সম্রাটকেও সেখানে সমাহিত করা হয়, যাদের মধ্যে দ্বিতীয় ভিত্তোরিও ইমানুয়েলসহ (মৃত্যু ১৮৭৮) এবং তার ছেলে উমবার্তো প্রথম, তাঁর পুত্রবধু ও কন্যাদের মরদেহ রয়েছে।

বর্তমান সময়ে গোটা স্থাপনাটি একটি ক্যাথলিক মন্দির হিসেবে দৃশ্যমান এবং সারা বিশ্বের পর্যটকদের জন্য অন্যতম গন্তব্য কেন্দ্র। নিয়মিত ক্যাথলিক গণসমাবেশ হয়ে থাকে চার্চটিতে।

প্রাচীন রোমের অন্যতম সেরা অবদান এই প্যানথিয়ন। আধুনিক স্থাপত্যের উপর প্যানথিয়নের প্রভাব ব্যাপক। বিশ্বের বহু স্থাপনা, লাইব্রেরী ও সরকারী ভবন প্যানথিয়ন কাঠামোর আদলে তৈরী করা হয়। তাছাড়া, এটিও সম্ভব যে, প্যানথিয়ন পশ্চিমা ধর্মের উপর প্রভাব ফেলেছে। ধারণা করা হয়, সাধারণ মানুষ প্রবেশাধিকার পেয়েছে, এমন প্রথম মন্দির প্যানথিয়ন। প্রাচীন বিশ্বের মন্দির সাধারণত নির্দিষ্ট পুরোহিতদের জন্য সীমিত ছিল, কিন্তু প্যানথিয়নে জনগণের প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়েছিলো।

সম্রাট হ্যাড্রিয়ান প্যানথিয়ন সম্পর্কে লিখেছেন, “আমার উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত ঈশ্বরদের এই আশ্রয়স্থল- পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ এবং তেজস্ক্রিয় গোলকের আকারে পুনর্নিমাণ করা উচিত। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আমাদের ভূমি পরিস্কার রাখবে … এটিকে কেন্দ্র করেই আমাদের সমৃদ্ধি এগিয়ে যাবে। সবাই এতে সমানভাবে অংশ নিবে এবং এক হয়ে আমরা উন্নতির পথে যাবো।”

এছাড়া, প্যানথিয়ন বর্তমান ইতালীর পর্যটক আকর্ষণে যেমন ভূমিকা রাখছে, পাশাপাশি জিডিপির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। ফলত, ভবনটির ব্যাপকতা সম্পর্কে আমরা আরও স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারি।

পরিশেষে, এটুকুই বলবো, বিশ্ব সভ্যতা বর্তমানে নানান রকমের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে গেলেও ইতিহাস ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ এক আবাসস্থল। প্যানথিয়ন আমাদের জীবন ঐতিহ্যে তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিবেচনা করেই আমরাও চাই, পৃথিবীর বুকে অনন্তকাল টিকে থাকুক প্রাচীন সভ্যতার এই অমূল্য সম্ভার! একই সাথে উৎকর্ষ ঘটুক বর্তমান শিল্প ও সাহিত্যের।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগ:

রোমান প্যানথিয়নের স্থাপত্যশৈলী

প্রকাশ: ১২:০৪:১৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ অগাস্ট ২০২২

নওশীন নাওয়ার রাফা: বিশ্ব ইতিহাসেরই এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় প্রাচীন রোমান সভ্যতা। শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ এবং গৌরব ও গরীমায় রোমান সভ্যতা বর্তমান পৃথিবীর কাছেও এক বিস্ময় জাগানিয়া নাম! বিশেষ করে, স্থাপত্য শিল্পে রোমানরা যে অগ্রগতি সাধন করেছিলো, তার নিদর্শন আজও বিশ্বের বুকে সমুজ্জ্বল রয়েছে স্বমহিমায়! এর মাঝে যে কাঠামোটি আজও সবচেয়ে অক্ষত অবস্থায় প্রায় ২০০০ বছর যাবত বিশ্ব বুকে টিকে রয়েছে কিংবা সংরক্ষণ করা হয়েছে, তার নাম প্যানথিয়ন।

বর্তমানে এটি মূলত একটি খ্রিস্টান ক্যাথলিক চার্চ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই স্থাপনাটিকে প্রাচীন রোমান মন্দির হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে, এর পরিচিতি যা-ই হোক না কেনো, কিংবা এর নির্মাতা, নির্মাণ কাল কিংবা অবস্থান -সবকিছু বর্ণনা ও আলোচনার পূর্বে এটি বলে রাখা আবশ্যক যে, প্যানথিয়ন একটি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া শিল্প। পৃথিবীর আশ্চর্য হিসেবে মিশরের পিরামিড যেমন হাজারো বছর ধরে আজও অক্ষত রয়েছে, প্যানথিয়নও সমান আকর্ষণ ও বিস্ময় নিয়ে আমার বিমোহিত করে চলেছে! বরং, স্থাপত্য তুলনায় কোন কোনো অংশে পিরামিডের চেয়েও প্যানথিয়ন অনন্য, কেননা, প্যানথিয়নের উপরে গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ বিদ্যমান। তাই বলা যায়, নির্মাণশৈলী এবং কারুকার্যে প্রাচীন রোমান মন্দির প্যানথিয়ন দৃষ্টি জুড়ানো এক নিদর্শন।

আমরা পূর্বেই জেনেছি যে, প্যানথিয়ন মূলত একটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টপূর্বাব্দে ২৭-২৫ সনে প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাসের জামাতা মার্কাস ভিপসিনিয়াস আগ্রিপ্পার অধীনে এটি নির্মিত হয়। বর্তমানে ইতালির রোমে স্থাপনাটি অবস্থিত। বিশ্বের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র এটি।

প্রাচীন রোমান বিশ্বাস মতে, স্বর্গের ১২ দেবতার আবাসস্থল তথা চারণভূমি ছিলো এই চার্চটি। তাই মন্দিরটি দেবতাদের প্রতিই উৎসর্গীকৃত ছিল। মূল কাঠামোর নাম গ্রীক শব্দ ‘প্যান’ থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ ‘সমস্ত’ এবং ‘থিওস’ অর্থ ‘দেবতা’।

তবে, খ্রিস্টাব্দ ৪০ সালে আগ্রিপ্পার কাঠামোটি আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সম্রাট ডোমিশিয়ান এর সময়কালে খ্রিস্টাব্দ ১১০ সালে ভবনটি আবারও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমানে আমরা যে প্যানথিয়ন স্থাপনাটি দেখতে পাই, তা ১১৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হ্যাড্রিয়ানের নেতৃত্বে পুনর্নির্মাণ করা হয়। তিনি আগ্রিপ্পার মূল ভবনের কাঠামোটি বহাল রাখেন।

ইতিহাসের পাতা উল্টালেই আমরা দেখতে পাই, প্যানথিয়নের নকশা সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকা জুড়ে অসংখ্য ভবনকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু, প্যানথিয়নের মূল স্থপতির পরিচয় আজও অজানাই রয়ে গিয়েছে। তবে, বেশিরভাগ ইতিহাসবেত্তাই দামাস্কাসের বিখ্যাত স্থপতি অ্যাপোলোডোরসকে এই স্বীকৃতি দেন।

হ্যাড্রিয়ানের প্যানথিয়নের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ। বিশ্বের বুকে যেসব স্থাপনা আজও মাথা উঁচু করে কিংবা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে টিকে আছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই ছাদ স্তূপবিশিষ্ট কিংবা সমতল। অথচ, গম্বুজ বিশিষ্ট ছাদ নিয়ে প্যানথিয়ন আজও যেভাবে টিকে রয়েছে, তা সত্যিই অনন্য!

এর গম্বুজের ব্যস প্রায় ৪৩.৩০ মিটার, যা অসাধারণ! কেননা, স্থাপত্য শিল্পের ভাষায় এত বড় ডায়ামিটারের ব্যস তৈরীর জন্যে গম্বুজটির খুবই মোটা ও পুরো কাঠামো প্রয়োজন, যা একই সাথে ওজনেও কম হতে হবে, যেনো গ্র্যাভিটির টানে তা ভেঙ্গে না পড়ে! শুধু তাই নয়! স্থাপনাটিকে আরও শৈল্পিক করে তুলতে কাঠামোর মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতাও দেয়া হয়েছিলো ৪৩.৩০ মিটার (১৪২ ফুট) ।

পাশাপাশি এতে কোনো জানালা ব্যবহৃত হয়নি। জানালার পরিবর্তে গোটা কাঠামো জুড়ে দেয়ালের উপর দিকে ছোট কিছু এবং গম্বুজের মাঝে একটি ছিদ্র করা হয়েছিলো, যা দিয়ে সূর্যালোক ভেতরে প্রবেশ করে! স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞানও যাদের রয়েছে, তারাই অনুধাবন করতে পারবেন, বিষয়টি কতকটা মায়াজাল তৈরীর মতো! কেননা, সূর্য দিনের একেক সময়ে একেক অংশে অবস্থান করবে! ফলে, ভেতরে প্রবেশ করা সূর্যালোক ইন্দ্রজালের ন্যায় রহস্যঘন দেখাবে।

তাছাড়া, এই মন্দিরের সম্মুখভাগে যে পিলারগুলো রয়েছে, সেগুলোও অতুলনীয়। এতবছর যাবত কাঠামোটির ভার বয়ে চলেছে পিলারগুলো। অথচ গম্বুজটি পিলারবিহীন। ভাবতে অবাক লাগে, এত সূক্ষ্ম স্থাপত্যশিল্প, যা বর্তমানের জন্যেও চ্যালেঞ্জিং, তা প্রায় ২০০০ বছর আগে কীভাবে বাস্তবায়ন করেছিলেন প্রাচীন রোমান কারিগরেরা! যদিও, অনেকে ধর্মাবলম্বীই মনে করেন, ভবনটি স্বয়ং ঈশ্বর রক্ষা করছেন।

প্যানথিয়নের নির্মাণশৈলীতে গ্রীক এবং রোমান উভয় ধারার প্রভাবই দেখতে পাওয়া যায়। প্যানথিনের গম্বুজটি প্রাচীনকালের বৃহত্তম জীবিত গম্বুজ, যা এককালে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গম্বুজের মর্যাদার অধিকারী ছিলো। গম্বুজের পুরুত্ব ৬.৮ মিটার (২১ ফুট)। মূল ভবনে প্রবেশের পরই দর্শনার্থীগণ একটি বিশালাকার বৃত্তাকার কক্ষ আবিস্কার করবেন। গম্বুজের শীর্ষে অবস্থিত অকুলাসটি নির্মাণকাল হতে আজ অবধি কখনোই আচ্ছাদিত ছিলো না, ফলে বৃষ্টিপাত হলে তা ভবনের ভেতরে পতিত হয়। তাই, জল নিস্কাশনের জন্য ভেতরেই একটি ড্রেন (প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বা ১২ ইঞ্চি) দিয়ে সজ্জিত তল রয়েছে। ভবনের চারপাশে থাকা সূর্যালোক প্রবেশের ছিদ্রগুলো শীতলকরণ এবং বায়ু চলাচলের জন্যেও কাজ করে। তাছাড়া, গোটা ভবনটি কংক্রিটের তৈরী। প্যানথিয়নের সামনের পিলারগুলো মূলত করিন্থিয়ান ধাচের কলাম (৮টি বৃহৎ গ্রানাইট)।

যদিও প্যানথিয়ন হাজারো বছর ধরে স্বীয় মহিমায় টিকে রয়েছে, কিন্তু, এর নির্মাণ শৈলীর প্রকৃত রহস্য আজও অনুদ্ঘাটিত। কীভাবে দু হাজারেরও বেশি সময় পূর্বের স্থপতিগণ বর্তমানের মতো স্ট্রাকচার তৈরী করতে সমর্থ হলেন, সেটিও এক মহাবিস্ময়! তবে, এটি বলা যায় যে, প্যানথিয়ন এক নিখুঁত জ্যামিতিক ভবন।

খ্রিস্টান গীর্জায় পরিণত হওয়ার পর প্যানথিয়ন রেনেসাঁ যুগের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে, বিখ্যাত অনেক রেনেসাঁ কারিগর, যেমন: চিত্রশিল্পী রাফেল, সুরকার আর্কাঞ্জেলো কোরেলি এবং স্থপতি বালদাসার পেরুজিসহ প্রভূত রেনেসাঁ শিল্পীদের ব্যক্তিত্বদের সমাধিস্থল হয়ে ওঠে স্থাপনাটি। বেশ কয়েকজন রাজা ও সম্রাটকেও সেখানে সমাহিত করা হয়, যাদের মধ্যে দ্বিতীয় ভিত্তোরিও ইমানুয়েলসহ (মৃত্যু ১৮৭৮) এবং তার ছেলে উমবার্তো প্রথম, তাঁর পুত্রবধু ও কন্যাদের মরদেহ রয়েছে।

বর্তমান সময়ে গোটা স্থাপনাটি একটি ক্যাথলিক মন্দির হিসেবে দৃশ্যমান এবং সারা বিশ্বের পর্যটকদের জন্য অন্যতম গন্তব্য কেন্দ্র। নিয়মিত ক্যাথলিক গণসমাবেশ হয়ে থাকে চার্চটিতে।

প্রাচীন রোমের অন্যতম সেরা অবদান এই প্যানথিয়ন। আধুনিক স্থাপত্যের উপর প্যানথিয়নের প্রভাব ব্যাপক। বিশ্বের বহু স্থাপনা, লাইব্রেরী ও সরকারী ভবন প্যানথিয়ন কাঠামোর আদলে তৈরী করা হয়। তাছাড়া, এটিও সম্ভব যে, প্যানথিয়ন পশ্চিমা ধর্মের উপর প্রভাব ফেলেছে। ধারণা করা হয়, সাধারণ মানুষ প্রবেশাধিকার পেয়েছে, এমন প্রথম মন্দির প্যানথিয়ন। প্রাচীন বিশ্বের মন্দির সাধারণত নির্দিষ্ট পুরোহিতদের জন্য সীমিত ছিল, কিন্তু প্যানথিয়নে জনগণের প্রবেশের সুযোগ দেয়া হয়েছিলো।

সম্রাট হ্যাড্রিয়ান প্যানথিয়ন সম্পর্কে লিখেছেন, “আমার উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত ঈশ্বরদের এই আশ্রয়স্থল- পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ এবং তেজস্ক্রিয় গোলকের আকারে পুনর্নিমাণ করা উচিত। আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টি আমাদের ভূমি পরিস্কার রাখবে … এটিকে কেন্দ্র করেই আমাদের সমৃদ্ধি এগিয়ে যাবে। সবাই এতে সমানভাবে অংশ নিবে এবং এক হয়ে আমরা উন্নতির পথে যাবো।”

এছাড়া, প্যানথিয়ন বর্তমান ইতালীর পর্যটক আকর্ষণে যেমন ভূমিকা রাখছে, পাশাপাশি জিডিপির উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। ফলত, ভবনটির ব্যাপকতা সম্পর্কে আমরা আরও স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারি।

পরিশেষে, এটুকুই বলবো, বিশ্ব সভ্যতা বর্তমানে নানান রকমের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে গেলেও ইতিহাস ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধ এক আবাসস্থল। প্যানথিয়ন আমাদের জীবন ঐতিহ্যে তেমনই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিবেচনা করেই আমরাও চাই, পৃথিবীর বুকে অনন্তকাল টিকে থাকুক প্রাচীন সভ্যতার এই অমূল্য সম্ভার! একই সাথে উৎকর্ষ ঘটুক বর্তমান শিল্প ও সাহিত্যের।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়