নওশীন নাওয়ার রাফা: জ্ঞান, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, স্থাপনা ও শিল্পচর্চার এক অপূর্ব ভান্ডার বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা। কিন্তু, একদিনে গড়ে উঠেনি আজকের এই সভ্য সমাজ। পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস সুপ্রাচীন। মানব সভ্যতার বর্তমান উৎকর্ষ ও বিকাশের পেছনে রয়েছে অতীতের হাজারো জাতিগোষ্ঠীর কঠিন ও কঠোর তপস্যা। বিবর্তনের সাক্ষী হয়ে আদিকাল থেকে অদ্যবধি টিকে রয়েছে বিশ্ব সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন!
চীনের মহাপ্রাচীর, মেক্সিকোর চিচেন ইৎজা, ইতালির কলোসিয়াম, পেরুর মাচু-পিচু, আগ্রার তাজমহল, এথেন্সের অ্যাক্রোপলিস, তুরস্কের হায়া-সোফিয়া কিংবা মিশরের পিরামিড- সবই স্থাপত্য সভ্যতার কালজয়ী নিদর্শন! আমাদের মনে আজও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এসব অসাধারণ স্থাপত্য ও নিপুণ শিল্পকর্ম। বস্তুত, উপরোল্লিখিত প্রতিটি নিদর্শনই শিল্পকলার ইতিহাসে অমর ও কিংবদন্তী তূল্য। তেমনই এক বিস্ময় জাগানিয়া নাম ‘পার্সেপোলিস’, যা বর্তমান ইরান, তথা প্রাচীন পারস্যের অ্যাকামেনিড রাজবংশের সম্রাটদের রাজপ্রাসাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
পরিচিতি, নামকরণ, অবস্থান: ইতিহাস ঘাটলে আমরা দেখতে পাই, পার্সেপোলিস নামটি দিয়েছিলো গ্রীকরা। ‘পার্সেপোলিস’ শব্দটিও এসেছে মূলত গ্রীক অভিধান থেকেই। এর অর্থ, পার্সিয়ান সিটি। পার্সে’ অর্থ পারস্য বা পারশিক। ‘পোলিস’ অর্থ নগর রাষ্ট্র। কাজেই, পার্সেপোলিস অর্থ পারশিকদের নগররাষ্ট্র।
তবে, পার্সেপোলিসের অধিবাসী পার্সিয়ানরা এটিকে পারসা (পারসিয়ানদের শহর) বলেই ডাকতো। প্রাচীন পারস্যের অ্যাকামেনিড রাজবংশের সম্রাট দারিয়ুস (প্রথম) দ্য গ্রেট এর নির্মাণ করেন। বর্তমান ইরানের দক্ষিণে অবস্থিত ফারস প্রদেশের একটি প্রান্তরের নাম মারভ দাস্ত। এখানেই ইতিহাস খ্যাত পার্সেপোলিস এর অবস্থান।
গোড়াপত্তন: বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তি মাত্র জানেন, প্রাচীন পারস্যের অ্যাকামেনিড রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সাইরাস দ্য গ্রেট। তাঁর রাজধানী ছিলো পাসারগাদে শহরে। পরবর্তীতে সাইরাসের ছেলে গাওমাতাকে হত্যা করে পারস্যের ক্ষমতা দখল করেছিলেন দারিয়ুস (প্রথম)। সিংহাসনে আরোহন করেই ষড়যন্ত্রীদের দূর্বল করতে ও নিজ অনুগতদের এককাট্টা করতে রাজধানী ও রাজভবন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ফলে পাসারগাদে শহর থেকে ২৫ মাইল উত্তরে শুরু করেন পার্সেপোলিস’ নির্মাণের কাজ।
তবে, ইতিহাসবিদদের একটি অংশ দাবি করেন, সম্রাট সাইরাস পার্সেপোলিস নগরীর ভিত্তি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে এখানে প্রাসাদ নির্মাণ করেন সম্রাট দারিয়ুস (প্রথম)। তবে একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সুনিশ্চিত যে, পার্সেপোলিস প্রাসাদ ও পর্ষদ হল, রাজকোষ ও সীমানা নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু হয় দারিয়ুসের আমলে, যার সুন্দর সমাপ্তি করেন তাঁর ছেলে পরবর্তী সম্রাট জারজেস দ্য গ্রেট।
বর্তমানে প্রাপ্ত প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পার্সেপোলিস স্থাপন শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫ সালে (মতান্তরে খ্রিস্টপূর্ব ৫১৮ সালে) । পরবর্তীতে, অ্যাকামেনিড সাম্রাজ্য ধ্বংস হওয়ার আগ অবধি রাজধানী হিসেবেই ব্যবহৃত হতো ইতিহাসের বিস্ময় পার্সেপোলিস।
নির্মাণশৈলী: পার্সেপোলিসের মূল ভিত্তি ছিলো সমতল থেকে উঁচু, ৪৫০ মিটার দীর্ঘ এবং ৩০০ মিটার প্রশস্ত চত্বর। সেই উঁচু প্রশস্ত চত্বরে ছিলো মূল রাজভবন। গোটা প্রাসাদের দেয়ালে ছিল খোদাই করা নকশা। ভবনের পূর্বে ছিলো আরও কিছু ভবন ও দূর্গের মতো পাহাড়। তবে, পার্সেপোলিসের ঠিক কোন অংশে বা কোথায় সাধারণ মানুষ বাস করতো, তা আজও সঠিকভাবে অনুমান করা সম্ভব হয়নি।
তৎকালীন সবাইকে পার্সেপোলিসের ১৪ মিটার উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হতো। মূল প্রবেশ পথে একটা পাথরের ষাঁড়ের প্রতীমা ছিলো, যা রাজার শক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো (উলটো দিকে মানুষমুখো ডানাওলা ষাঁড়) । ভীতিকর এই জন্তুগুলোর অবয়ব পেরিয়ে তারপর চত্বর, যার চারিদিকে স্তম্ভ, দরজা। এটিই ছিলো সম্রাটের আপাদানা বা সম্মেলন কক্ষ; যা ২.৬ মিটার উঁচুতে পৃথক একটি পোডিয়ামের ওপর দাঁড়িয়ে এবং যার প্রতি পাশে ১১০ মিটার দীর্ঘ ৬টি স্তম্ভের ৬টি সারি।
স্তম্ভের ভিত্তি চৌকোন। স্তম্ভের শীর্ষে ছাদের কাছে জন্তুর মুখ যা রাজার নিকট বশ্যতার প্রতীক। স্তম্ভগুলোর মাঝখানে ৫ মিটার পুরু ইটের দেয়াল। ভিতরে প্রথমে বড় একটা হল রুম। তারপরে বেশ কয়েকটি কক্ষ। এসব কক্ষের প্রায় প্রতিটির দেয়ালে দেখা যাচ্ছে, পারশিক বীরগণ হত্যা করছে বিভিন্ন হিংস্র পশু, এমন চিত্র। চত্বরের পশ্চিম কোণে ছিল দারিয়ুসের প্রাসাদ, যাতে প্রবেশের দরজা ছিল একটিই, সম্মুখভাগে প্রহরীকক্ষ।
পার্সেপোলিসের এতসব নির্মাণশৈলী বিশ্লেষণ করলে আমরা একটি সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সের সন্ধান পাই। এই কমপ্লেক্সটি মূলত নয়টি কাঠামো নিয়ে গঠিত। সেগুলো যথাক্রমে, ১. আপাদানা (হাইপোস্টাইল রিসিভিং হল বা সম্মেলন কক্ষ); ২. ত্রছারা (সম্রাট দারিয়ুসের প্রাসাদ); ৩. কাউন্সিল হল; ৪. কোষাগার; ৫. থ্রোন হল; ৬. জারজেস (প্রথম) -এর প্রাসাদ; ৭. জারজেস (প্রথম) -এর হারেম (সম্রাজ্ঞী ও অন্যান্য নারীদের বাসস্থান); ৮. গেট অফ অল নেশনস; ৯. রাজার সমাধি।
পার্সেপোলিসের এই নয়টি কাঠামোর মধ্যে প্রথম তিনটি নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট দারিয়ুস এবং বাকিগুলো তাঁর উত্তরসূরিদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিলো। বিশেষ করে, দারিয়ুস পুত্র জারজেস এবং নাতি আর্টাক্সারক্সেস কর্তৃক পার্সেপোলিসের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। এই নয়টি কাঠামো ছাড়াও আরও কিছু ধ্বংসাবশেষ পার্সেপোলিসে পাওয়া গিয়েছে, যা এখনও প্রত্নতাত্ত্বিকরা উদ্ঘাটন করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পার্সেপোলিস এর ধ্বংসকথা: পার্সেপোলিস শহরটি ইতিহাস খ্যাত হয়ে থাকার অন্যতম একটি কারণ ইতিহাসখ্যাত বীর আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট কর্তৃক এর ধ্বংস হওয়া। যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও ৩৩০ বছর আগে মিশর জয় করেন আলেকজান্ডার। এরপর আরও পূর্বে আসরিয়ার (বর্তমানে উত্তর ইরাক) দিকে অভিযানের মনস্থির করেন তিনি। এসময়, পারস্য সম্রাট দারিয়ুস (তৃতীয়) এর নেতৃত্বে গাউগামেলার যুদ্ধে পারস্য সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন গ্রীক বীর। পারস্য জয় করে পার্সেপোলিস দখল করেন মেসিডোনিয়ার সম্রাট আলেকজান্ডার। পার্সেপোলিসের গোটা রাজকোষ দখলে নেয়ার পাশাপাশি পরবর্তী কয়েক মাস সেনাবাহিনীকে শহর লুট করার অনুমতি দেন আলেকজান্ডার। এসময়ই কোন এক ঘটনাচক্রে আগুন লেগে ধ্বংস হয়ে যায় ইতিহাসের বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শন পার্সেপোলিস।
অভিযোগ রয়েছে, এক রাতে অতিরিক্ত মদ্যপান করে পার্সেপোলিসে আগুন লাগিয়েছিলেন খোদ আলেকজান্ডার। পুড়িয়ে দিয়েছিলেন পারস্য সাম্রাজ্যের গর্ব ভূমি। তবে, এক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছেন প্রাচীন নিকোমিডিয়ার ঐতিহাসিক আরিয়ান। তাঁর মতে, “৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংগঠিত হওয়া এক যুদ্ধে পার্সিয়ানরা এথেন্সকে পুড়িয়ে দিয়েছিলো। সেটার প্রতিশোধ হিসেবে পার্সেপোলিসকে ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সযত্নে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো।”
আরিয়ান লিখেছেন, “গ্রীকদের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আলেকজান্ডার পার্সেপোলিসের প্রাসাদটি পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। কারণ পার্সিয়ানরা আগুন এবং তলোয়ার দ্বারা গ্রীকদের মন্দির এবং শহর উভয়ই ধ্বংস করেছিল।”
প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব: পার্সেপোলিস ছিলো প্রাচীন অ্যাকামেনিড রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগরী। এখানে বসেই সম্রাটগণ গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘোষণা জারি করতেন, রাজস্ব আদায় করতেন তথা বিচারকার্য সমাধা করতেন। ১৩১৮ সালে একজন ইউরোপীয় অভিযাত্রীর লেখায় প্রথমবারের মতো ইউরোপ জানতে পারে পার্সেপোলিসের কথা। তারপর থেকে গবেষণা আরম্ভ হয় এলাকাটি জুড়ে।
১৭০৫ সালে ডাচ শিল্পী কর্নেলিস ডি ব্রুইন সর্বপ্রথম পার্সেপোলিসের বিশদ বিবরণ প্রকাশ করেন। ফরাসি প্রত্নতত্তবিদ ১৯৩০ সালে পার্সেপোলিস খনন করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। একই দশকে ইরানের প্রাচ্যীয় ইনস্টিটিউটের পার্সপোলিসে বৈজ্ঞানিক খনন শুরু করে।
এখনও অবধি অঞ্চলটি থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষগুলো অবস্থান এবং স্থাপনা, উপকরণ ও ফর্ম এবং নকশার দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে খাঁটি। পার্সেপোলিসে প্রাপ্ত ভবনগুলো আজও পুরোনো স্ট্রাকচারেই রয়েছে। পার্সেপোলিসের সাধারণ পরিকল্পনায় কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
তাছাড়া, পার্সেপোলিসে কোন আধুনিক পুনর্গঠন নেই; সমস্ত স্মৃতিস্তম্ভের অবশিষ্টাংশ খাঁটি। তাই এখানে আবিস্কৃত নানান বিষয় বর্তমান বিশ্ব সভ্যতাকে প্রাচীন বিশ্ব সম্পর্কে প্রভূত বিস্ময় উপহার দিতে পারে বলে বিশ্বাস বিশেষজ্ঞদের।
পার্সেপোলিস এর সংরক্ষণ: পার্সেপোলিস এনসেম্বল আইটেম নং হিসাবে ইরানের স্মৃতিস্তম্ভের জাতীয় তালিকায় নিবন্ধিত একটি স্থান। শহরটি রক্ষার্থে ১৯৮০ সালে গোপন খনন এবং অবৈধ খনন প্রতিরোধের আইনি বিল নিয়ে আসে ইরান সরকার। ইউনেস্কো ১৯৭৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ঘোষণা করে পার্সেপোলিসকে।
বর্তমানে এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সম্পত্তি, যা ইরান সরকারের মালিকানাধীন এবং এর বাফার জোন ইরানী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন শিল্প সংস্থার (যা ইরান সরকার দ্বারা পরিচালিত এবং অর্থায়ন করে) আইনি সুরক্ষা এবং ব্যবস্থাপনার অধীনে রয়েছে।
এখানে গবেষণার জন্য ২০০১ সালে ইরানের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পার্সেপোলিস রিসার্চ বেজ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পার্সেপোলিসের সংরক্ষণের জন্য আর্থিক সংস্থান ইরানের জাতীয় এবং প্রাদেশিক বাজেট থেকে নির্বাহ করা হয়। কিন্তু, বর্তমান বিকৃত বিশ্ব পরিবেশ বাস্তবতায় ক্রমাগত দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন সহ নানাবিধ সমস্যায় পার্সেপোলিসের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।
পরিশেষে, আমরা আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে কিংবা অজানাকে জানার মাধ্যমেই ভবিষ্যতকে সুন্দরের প্রয়াস করি। পার্সেপোলিসের মতো শহরগুলোই আমাদের বিশ্ব মানবতার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। বিদ্যমান বাস্তব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বিবেচনা করে আমরা চাই, পৃথিবীর বুকে অনন্তকাল টিকে থাকুক প্রাচীন সভ্যতার এই অমূল্য সম্ভার!
তথ্যসূত্র:
১। ইমন জুবায়ের. (০৮ ই নভেম্বর, ২০০৮). পার্সিপোলিস: প্রাচীন পারস্যের বিস্ময়কর স্থাপত্য নিদর্শন ।। https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/benqt60/28866414
২। কে। ক্রিস হার্স্ট ।। পার্সেপোলিস (ইরান) – ফার্সি সাম্রাজ্যের রাজধানী শহর ।। https://bn.eferrit.com/পারসেপলিস-ইরান-ফার্সি/
৩। পার্সেপোলিস ।। উইকিপিডিয়া
লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়