০৪:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইতালিতে রেনেসাঁস এর উদ্ভব ও বিস্তার

ইতালিতে রেনেসাঁস

নওশীন নাওয়ার রাফা: ইংরেজি ‘রেনেসাঁ’ (ফরাসি: Renaissance, ইতালীয়: Rinascimento) শব্দের অর্থ নবজাগরণ বা পুনর্জন্ম। ধর্মভাবনা নিয়ন্ত্রিত ও সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় দীর্ঘ বদ্ধ দশা থেকে মুক্ত হয়ে নতুনভাবে জীবনের সবকিছুকে জানার জন্য মানব মনের যে আকুলতা, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার জন্য যে ঐকান্তিক আগ্রহ তারই পরিণতি স্বরূপ যে নবজীবনবাদের সূচনা- তাকেই সাধারণভাবে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে আখ্যায়িত করা হয়। গোটা বিষয়টির আদ্যোপান্ত ব্যাপক বিস্তৃত ও সুগভীর হলেও এই লেখনীটিতে মূলত রেনেসাঁস এর উৎপত্তিস্থল ইতালি ও সেখানে নবজাগরণের বিস্তার সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।

মধ্যযুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্বাস সব কিছুই আবর্তিত হতো প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং কুসংস্কারের মায়াজালে আবদ্ধ মানুষ নিরুপায় ভাবেই এই নিয়ম মেনে চলতো। কিন্তু ইউরোপে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতক থেকে ক্রমেই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সাধারণ মানুষ যুক্তিতর্ক দ্বারা সবকিছুকে গ্রহণ বা বর্জন করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। সবকিছুকেই যাচাই করতে শেখে মানুষ। মানব মনের এই পরিবর্তন বা উন্নয়নই নবজাগরণ বা রেনেসাঁস।

মানব সভ্যতার ইতিহাস অতীত থেকে বর্তমান এবং বর্তমান থেকে আগামীর পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি আর অর্থনীতি ইতিহাসের কালের পরিসীমায় আবদ্ধ। ইতিহাসে কোনো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি একই ভাবে কিম্বা একই পন্থায় কিম্বা ধারায় ঘটে না। রেনেসাঁস মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান ঘটেছে, একই সঙ্গে অবসান ঘটে মধ্যযুগের। সে কারণেই রেনেসাঁসকে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না; এর ভিতরগত এবং বাহ্যিক মর্ম অত্যন্ত ব্যাপক।

প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁসের বলতে বুঝায় প্রাচীন যুগের গ্রেকো- রোমান সংস্কৃতির পুনরুত্থান তথা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ভাস্কর্যকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করে সত্য সুন্দরকে গ্রহণ করা, এর ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করা। তবে সংজ্ঞাটির প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো শুধুমাত্র প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান অধ্যয়ন এবং প্রয়োগ মানুষের দৃষ্টিভিঙ্গ গঠনে সহায়ক হলেও সামগ্রিক সমাজ বদলের প্রধান কারণ হতে পারে না।

রেনেসাঁসের প্রচলিত সংজ্ঞার প্রায় বিপরীতে আধুনিক সংজ্ঞাটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আধুনিক ইতিহাসবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে মধ্যযুগের সামন্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর স্থবিরতার অবসান ঘটিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমাজ জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে-এটাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণ। উক্ত নব জীবনের আলোকে ইউরোপের মানুষ তাদের অতীত ঐতিহ্য তথা গ্রিক ও রোমান যুগের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি পাঠে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে জীবন ও জগতকে যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হবে। আর এভাবেই শুরু হয় ইউরোপের ইতিহাসে এক নতুন পর্ব। পর্বটির উত্তরণ ঘটেছিল সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে। পঞ্চদশ শতকের ইউরোপের রেনেসাঁসকে প্রকৃত অর্থেই ইউরোপের ইতিহাসে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার এক অবস্থান থেকে গুণগতভাবে অন্য এক উত্তরণশীল পর্ব হিসেবে অভিহিত করা যায়।

সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগ থেকে বাণিজ্যিক ধনতন্ত্রে উত্তরণের আর্থসামাজিক পটভূমিতে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল, সেটিই ইতিহাসে রেনেসাঁস হিসেবে বিখ্যাত। চার্চশাসিত ভূমিনির্ভর মধ্যযুগীয় সমাজ রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি, অলৌকিকতার পরিবর্তে ইহজাগতিকতা, ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে মানবমুখিতা ও সৌন্দর্যচর্চা প্রাধান্য পায়। মানুষ’ই হয়ে ওঠে সবকিছুর মানদণ্ড। রেনেসাঁসের এটিই প্রথম প্রকাশ, যার মূল প্রত্যয় ছিল মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলা। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে নতুন যুগের আদর্শ হিসেবে রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটে, যা অলৌকিক ও দৈবের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকে ‘মানুষ’ করে তুললো।

ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, রেনেসাঁসের পীঠস্থান ইতালি। মূলত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষাংশে (মতান্তরে, ১২৮০ হতে) ইতালিতে রেনেসাঁস এর গোড়াপত্তন ঘটে। পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে রিফরমেশন, ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ বিপ্লব ও চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে। তবে যেহেতু ইতালিতেই প্রথম রেনেসাঁস এর উদ্ভব, সেহেতু, ইতালি পর্বের রেনেসাঁসকে রেনেসাঁসের আদি পর্ব বা রেনেসাঁসের প্রথম পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

তবে নবজাগরণের প্রকৃত সূচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের গোড়ায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছে। কিন্তু ভাব জাগতিক পরিবর্তনকে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা দ্বারা বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। চেতনার বিকাশ ঘটে ধীরলয়ে ক্রমান্বয়ে। একটি বোধ থেকে জন্ম নেয় আরেকটি বোধ। তাই কিছু পন্ডিত মনে করেন পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগরণের সুর ধ্বনিত হলেও তার প্রস্তুতি চলছিল আরো কয়েকশো বছর আগে থেকেই।

রেনেসাঁসে মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার অতুলনীয় বিস্ফোরণ ঘটে। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইতালিতে রেনেসাঁসের উজ্জ্বল সূচনা ও অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল। মধ্যযুগে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। রেনেসাঁস সে স্থানে অধিষ্ঠিত করে সংস্কৃতিকে। বেকন ও গ্যালিলিওর প্রভাবে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। মানবসভ্যতার এই ধারাবাহিক অগ্রগতির যাত্রাবিন্দু হচ্ছে রেনেসাঁস। তাই রেনেসাঁসকে বলা হয়েছে ‘মানব সভ্যতার প্রথম বসন্ত।’

ইতালীয় রেনেসাঁসকে রেনেসাঁসের আদি পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই রেনেসাঁস ইতালিতে শুরু হওয়ার কয়েকটি কারণ বিদ্যমান ছিল। সেগুলো যথাক্রমে, প্রথমত, ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান। ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তী দেশ হওয়ার কারণে মধ্যযুগে ইতালি ব্যবসা-বাণিজ্যে ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অগ্রগামী ছিল। উপরন্তু সাগর তীরবর্তী অবস্থানের কারণে ইউরোপের মূল ভূখন্ডের সামন্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামো ইতালিকে ততটা প্রাভাবিত করেনি। ফলে রেনেসাঁস সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি এখানে বিরাজমান ছিল।

দ্বিতীয়ত, ইতালীয়রা বরাবরই প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারক বাহক ছিলেন। এই প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য তাদেরকে নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

তৃতীয়ত, ইতালির ধর্মাধিষ্ঠানসমূহ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। এই জন্য দেখা যায় যে প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহে পোপগণ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। এটাও ইতালিতে রেনেসাঁস শুরুর অন্যতম কারণ।

চতুর্থত, ইতালি ছিল বিভিন্ন জাতির মিলন ক্ষেত্র। এখানে ফ্রাঙ্ক, জার্মান, নর্মান, গথ প্রভৃতি জাতি বসবাস করতো। এই বহু জাতির সহাবস্থানের ফলে এখানকার সামাজিক জীবনে সহমর্মিতা বিরাজ করতো। এই জন্য ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পন্ডিতেরা এখানে আগমন করেছিলেন।

তবে, যদিও ইতালিতে রেনেসাঁস শুরু হয়, তথাপি কালক্রমে আল্পস পর্বত অতিক্রম করে এর প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে এবং স্থানীয় শিল্প, সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়। সে জন্য এই সব রেনেসাঁস ফরাসি রেনেসাঁস, ইংরেজ রেনেসাঁস, জার্মান রেনেসাঁস ইত্যাদি নামে পরিচিত হতে শুরু করে।

নবজাগরণের মতো এত বড় বিষয় কোন ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হওয়া সম্ভব ছিলনা। তাই নবজাগরণের কারণ সু-বিস্তৃতভাবে আলোচনা সাপেক্ষ। সেগুলোর কয়েকটি যথাক্রমে:

মুদ্রণ যন্ত্রের প্রভাব: পঞ্চদশ শতকে জার্মানির গুটেনবার্গ নামক জনৈক ব্যক্তি মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার করলে সাহিত্যের বাণী সহজেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গুণী ব্যক্তিদের মতাদর্শের সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটতে শুরু করে। কবি সাহিত্যিক দার্শনিক বিজ্ঞানীর মৌখিক চিন্তাভাবনা পুস্তকে ছাপা হলে তা সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। নবজাগরণ দূত রূপে ছাপাখানার অবদান তাই অনস্বীকার্য। এছাড়া, ইতালিতে তারও প্রায় শ-খানেক বছর পূর্বেই সাহিত্যে নবজোয়ার আসে এবং মানুষের মননে পরিবর্তন শুরু হয়।

ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড: ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের কারণে প্রাচ্য সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার পরিচয় ঘটে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা প্রাচ্যে এসে এখানকার ভোগবাদী জীবন দর্শনের সাথে পরিচিত হন। প্রাচ্যের মানুষের বিলাস পূর্ণ জীবন যাপন পদ্ধতি পাশ্চাত্যের ধর্মযোদ্ধাদের আকৃষ্ট করে। গির্জার কঠোর জীবন যাপন পদ্ধতির প্রতি এরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এরাই  নতুন জীবন দর্শন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। যার পরিণতি নবজাগরণ।

নগরের ভূমিকা: নবজাগরণের জন্য এককভাবে ইতালির বহুমুখী অবদান রয়েছে। ইতালিতে নগর জীবনের সূচনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যবসা বাণিজ্য ভিত্তিক নগর গুলি প্রচলিত গ্রামীণ জীবনের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করায় তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরেই গ্রিক ও আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় ঘটে ইতালির নগর গুলির। এভাবে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে ইতালি। আর একই পথে ইতালির পর জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সূচনা ঘটে নবজাগরণের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান: পঞ্চদশ শতকের বহু আগে থেকেই ইতালিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সূচনা ঘটে। বোলোনা, মিলান, রেভিনা এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানপিপাসু ছাত্রদের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। ক্রমে প্যারি, অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ সহ বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং নবজাগরণের পথ প্রশস্ত হয়।

সাহিত্যে নবজাগরণ: মধ্যযুগের সাহিত্য ও শিল্প চর্চা ছিল ধর্মভিত্তিক ও গির্জা কেন্দ্রিক। নবজাগরণ ও মানবতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা বহন করে আনে। নতুন যুগের সাহিত্যে মানুষ বস্তুজগৎ ও প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নদী-পাহাড়, চন্দ্র-সূর্য এরাই হলো এ যুগের সাহিত্যের উপজীব্য। গির্জার নিয়ন্ত্রণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি হলো এ যুগের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য।

ইতালির নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা মহাকবি দান্তে ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তাঁর রচিত ‘ডিভাইন কমেডি’ ইতালীয় ভাষায় রচিত এক অমর সৃষ্টি। এই কাব্যে মধ্যযুগীয় জীবনধারা সমালোচনা মানুষের প্রেম-ভালোবাসা দেশপ্রেম প্রাকৃতিক ঘটনা এবং সর্বোপরি স্বাধীন সংঘবদ্ধ ইতালির জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে ‘ইতালির নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়। ফ্রান্সেস্কো পেত্রার্ক ছিলেন ফ্লোরেন্সের অধিবাসী। তিনি ছিলেন এযুগের মানবতাবাদ এর প্রবর্তক এবং এ যুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ মনীষী। তিনি হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যের অনুবাদ করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সনেটস টু লরা’।

বোকাচ্চিও ছিলেন ইতালির গদ্য সাহিত্যের জনক। তাঁর রচিত ‘ডেকামেরন’ নামক জীবনমুখী কাব্যটি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই গ্রন্থে সমাজের নানান জটিল ব্যবস্থা , যাজক ও অভিজাতদের দুর্নীতি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি সাধারণ মানুষের আনন্দ, ভালোবাসা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ফুটে উঠেছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক- কবি -রাজনীতিবিদ মেকিয়াভেলি-র ‘দ্য প্রিন্স’ নামক গ্রন্থটি অবিস্মরনীয়। তাঁর মতে রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্ম ,নৈতিকতার ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই। তাঁকে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়।

মধ্যযুগে ফ্রান্সে ট্রুবাদুর নামে একদল ভ্রাম্যমান গীতিকবির আবির্ভাব হয়। তাঁরা গীতি কবিতার মাধ্যমে গির্জা ও যাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। জিওফ্রে চসার ছিলেন ইংল্যান্ডের অপর একজন বিখ্যাত কবি । তিনি ইংরেজি কাব্যের জনক নামে পরিচিত। সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। স্যার ফ্রান্সিস বেকন মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে যুক্তি তর্কের দ্বারা সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাকে ইংরেজি দর্শনের আদি গুরু বলা হয়।ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে উয়িলিয়াম শেক্সপিয়র আবির্ভূত হন। ম্যাকবেথ,হ্যামলেট,জুলিয়াস সিজার,মার্চেন্ট অফ ভেনিস প্রভৃতি তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।

শিল্পে নবজাগরণ: জিয়োটো ছিলেন চতুর্দশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। তাকে চিত্রাঙ্কনে নবজাগরণের আদি রূপকার বলা চলে। চিত্রশিল্পী বত্তিচেলি মানুষের প্রেম, দুঃখ,প্রবঞ্চনা প্রভৃতি বাস্তব রূপ নিয়ে শিল্পকর্ম করেছেন। তার ‘দি বার্থ অফ ভেনাস’ চিত্রটি অবিস্মরনীয়। ভেনিসের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী টিশিয়ান প্রায় সাতশ চিত্র অঙ্কন করেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী। তার অঙ্কিত ‘মোনালিসা’ ও ‘শেষ ভোজ’ চিত্রটি আজও মানুষের বিষ্ময়ের উৎপাদন করে। ইতালির বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও স্থপতি রাফায়েল এ যুগের আরেক বিস্ময়। তিনি ছিলেন ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। তার অঙ্কিত ‘ম্যাডোনা’ বা মাতৃমূর্তি অর্থাৎ মাতা মেরীর চিত্র গুলির চিত্র শিল্পের ইতিহাসে বিস্ময়কর সৃষ্টি। সমকালীন পোপ ও যাজকরা তাকে শ্রেষ্ঠ চিত্রকর বলে সম্মান জানাতেন। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর মাইকেল এঞ্জেলোর নতুন নতুন ভাবনায় চিত্রাঙ্কন মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ‘শেষ বিচার’ নামক বিখ্যাত ছবিটি। রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জা তৈরির ব্যাপারে তার শিল্প দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বিজ্ঞানে নবজাগরণ: রজার বেকন ছিলেন নবজাগরণ যুগের অন্যতম বিজ্ঞানী। তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হত। তিনি পদার্থবিদ্যা, আলোক বিজ্ঞান, রসায়ন প্রভৃতি নানা শাস্ত্রে বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় রাখেন। এই কারণে তাঁকে ‘বিস্ময়কর ডাক্তার’ বলা হয়। চশমার কাঁচ, অণুবীক্ষণ- দূরবীক্ষণ যন্ত্র এবং বারুদের আবিষ্কারে তার অসামান্য অবদান ছিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘ওপাশ মাজুস’।

ইংল্যান্ডের আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন ফ্রান্সিস বেকন। প্রকৃতি বিজ্ঞান চর্চায় তার প্রবল উৎসাহ ছিল। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘নোভাম অর্গানাম’। বিজ্ঞান চর্চায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আধুনিক পদ্ধতিতে খাল খনন ও দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি দেখিয়েছেন।

কোপার্নিকাস জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি প্রমাণ করেন যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘অন দ্যা রিভলিউশন অফ সেলেস্টিয়াল অর্ডার’। গ্যালিলিও ছিলেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি দেখা সম্ভব হয় তাঁর জন্যই। গুটেনবার্গ ছিলেন সর্বপ্রথম মুদ্রণ যন্ত্র ও সীসার অক্ষরের সাহায্যে বই ছাপার পদ্ধতির আবিষ্কারক।

ইতালিতে রেনেসাঁস সংঘটিত হওয়ার পেছনে অন্যান্য অনুঘটকসমূহ নিয়েও এক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে। সেগুলো যথাক্রমে,

আরবীয় সভ্যতার প্রভাব: ইউরোপে রেনেসাঁস সৃষ্টির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে আরবীয় সভ্যতার প্রভাবকে অভিহিত করা যায়। মধ্যযুগের সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা হলো আরবীয় সভ্যতা। হযরত মোহাম্মদের (সঃ) আগমনের ভেতর দিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব জনগোষ্ঠী জেগে উঠে। ইসলামের মহান সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা, অধিকার, জ্ঞান সাধনা, মানবতাবোধ, ধৈর্য ও সাহসকে ধারণ করে অল্প সময়ের মধ্যে আরবরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর পরলোকগমনের শতাব্দীকালের মধ্যেই আরবরা সমগ্র পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, ভারতবর্ষ, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের স্পেন দখল করে। এই বিজয়ের পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতেও আরবদের অসাধারণ সাফল্য সমগ্র বিশ্বকে অবাক করে দেয়। আব্বাসীয় শাসনামলে শুরু হয় আরবদের জ্ঞান সাধনার ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ। বিশেষত সাহিত্য, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি জ্ঞানের মৌলিক শাখায় আরবদের অবদান ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। একাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ক্রুসেড অভিযানের সময় ইউরোপীয়রা আবরবদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্সে আসে। আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপবাসীকে জাগ্রত করতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। এইভাবে আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপের রেনেসাঁস সৃষ্টিতে পালন করে এক ইতিবাচক ভূমিকা।

জীবন ও জগতের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গী: ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইতালির মানুষের জীবন ও জগতের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মীয় শাসন ও শোষণের ফলে মানুষের চিন্তার কোনো প্রকার স্বাধীনতা ছিল না। চর্তুদশ শতক থেকে সামন্তবাদী আর্থ-সামাজিক কাঠামো দুর্বল হয়ে আসার পটভ‚মিতে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। এই সময় থেকে পোপতন্ত্রের প্রভাব এবং ধর্মীয় অনুশাসন সমাজ জীবনে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে জীবন ও জগতের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন হতে থাকে। অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার জন্য মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ জাগ্রত হয়। মানুষ যুক্তি এবং বুদ্ধি দিয়ে দেশ ও সমাজকে বিচার করতে শুরু করে। ইতিহাসের এই প্রক্রিয়া ইউরোপে নবজাগরণে এক ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করে।

নতুন সাহিত্যের বিকাশ: ইউরোপের রেনেসাঁস সৃষ্টিতে নতুন সাহিত্যের বিকাশ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এইক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ইতালির চারণ কবিগণ। তারা রাজা আর্থার, শার্লামেন, হোলি গ্রেল প্রমুখদের উপর গীতি রচনা করে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলন করেন। স্পেনের কবিরা এক ধরনের লোকজ ঐতিহ্যাশ্রয়ী কবিতা রচনা শুরু করে। এই ধরনের কবিতাকে বলা হতো সিড। ইতালির কবি দান্তে তার রচিত ’ডিভাইন এন্ড কমেডি’ নামক গ্রন্থে ইতালির কথ্য ভাষাকে সাহিত্য রচনার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইংল্যান্ডে চ্যসার ‘কেন্টারবেরি টেলস’ গ্রন্থে রোমান ও স্যাকসন ভাষার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে আধুনিক ইংরেজি ভাষার প্রকৃত রূপদান করেন। এই ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ইউরোপের রেনেসাঁসকে নতুন গতি দান করেছিল।

ইতালির শহরগুলোর অবদান: ইতালি তথা ইউরোপে রেনেসাঁ সৃষ্টিতে ইতালীর শহরগুলোর অবদান অবশ্যই স্মরণীয়। ইতালির দক্ষিণ অঞ্চল ভূমধ্যসাগরীয় তীরবর্তী। এই অঞ্চলে এর বাণিজ্য শহরগুলি গড়ে উঠেছিল। এই শহরগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল বাণিজ্য। বাণিজ্যের প্রয়োজনে এই শহরগুলিতে গড়ে উঠে ছোট ছোট কারখানা। ইউরোপের সামন্তবাদী আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রভাব সাগর তীরবর্তী এই শহরগুলোতে খুবই দুর্বল ছিল। ফলে এই শহরগুলিতে স্বাধীন চিন্তা – চেতনা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং নাগরিক আদর্শ সৃষ্টির এক অনুকূল পরিবেশ ছিল বিরাজমান। উপরন্তু মানুষের ত্মনির্ভরশীল হওয়ার মত সুযোগ এখানে বর্তমান ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবে মানুষের মন ও মানসিকতায় উদারনৈতিক ভাবনা, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী, সাহিত্য, শিল্পকলার প্রতি গভীর আকর্ষণের সৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুত জেনোয়া, ফ্লোরেন্স, ভেনিস প্রভৃতি শহর ইউরোপে রেনেসাঁস সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল।

মানবতাবাদী লেখকদের অবদান: ইতালিতে রেনেসাঁসের পেছনে মানবতাবাদী পন্ডিতদের অবদান অপরিসীম। জ্ঞানের সাধক এই সকল পন্ডিতেরা মানুষের সামগ্রিক কল্যানের জন্য, মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। অতীত যুগের ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করে অর্জিত জ্ঞান সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা ছিল তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। জ্ঞান জগতে তাদের বিচরণ ছিল খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক চিন্তা ভাবনার বাইরে প্রধানত গ্রিক ও রোমান শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও এবং দর্শনে। চিন্তা ও মননে এই সকল পন্ডিত ছিলেন উদারনৈতিক, সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তাদের একটি প্রধান কাজ ছিল প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও প্রচার করা। মানবতাবাদী পন্ডিতদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রেত্রার্ক এবং বোক্কাচো।

ফ্রান্সিস পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪): ইতালির মানবতাবাদী পন্ডিতদের মাঝে প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন ফ্রান্সিস পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪) । তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য জানা যায় না। তিনি অনেক পরিশ্রম করে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের প্রায় দুইশত পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। বিশেষত তাঁর সংগৃহীত প্লেটোর গ্রন্থাবলী এবং হোমারের মহাকাব্য তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। ইতালির শত শত তরুণ প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষা ছেড়ে দিয়ে পেত্রার্কের শীষ্যত্ব গ্রহণ করে। ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানে এক প্রবল যুক্তিবাদের ধারার সৃষ্টি হয়। প্রেত্রার্কের জ্ঞান সাধনার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি তরুণদের মনে নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। তিনি সনেট নামক চৌদ্দ লাইনের কবিতারও জনক। এই কবিতার ধারা পরবর্তীকালে পৃথিবীর সব সাহিত্যের কবিদের কমবেশি প্রভাবিত করেছে।

বোক্কাচো (১৩১৩-১৩৭৫): এই সময়ের একজন অন্যতম মানবতাবাদী লেখক হলেন গিওভান্নি বোক্কাচো (১৩১৩- ১৩৭৫)। তিনি ইতালির গদ্য সাহিত্যের জনক। তাঁর লিখিত ’ডেকামেরেন’ গ্রন্থ ইতালির গদ্য সাহিত্যের পথ প্রদর্শকের ভ‚মিকা পালন করেছে। তিনি গ্রিক ভাষা শিক্ষা করেন এবং মহাকবি হোমারের দুটি মহাকাব্য ’ইলিয়ড’ ও ’ওড়েসা’ লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। বোক্কাচোর আরেকটি কৃতিত্ব হলো গ্রিক ও রোমান যুগের প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ এবং এগুলির কপি প্রস্তুত করে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা। মানুষের কর্মকান্ডের ওপর গভীরভাবে আস্থাশীল, মানুষের অমিত সম্ভাবনা শক্তিতে বিশ্বাসী বোক্কাচোর লেখনী ও চিন্তাধারা ইতালির তরুণদেরকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল।

মানবতাবাদী শিল্পীদের অবদান: পঞ্চদশ শতকের মানবতাবাদী শিল্পীরা রেনেসাঁসের সৃষ্টি এবং বিকাশে এক অভ‚তপূর্ব ভ‚মিকা পালন করেছিল। মধ্যযুগের শিল্পকলার বিষয়বস্তু ছিল ঈশ্বর এবং যিশু। মানবতাবাদী শিল্পীদের শিল্পকার্যের বিষয়বস্তু ছিল মানুষ ও পৃথিবীতে মানুষের জীবন। পৃথিবীতে মানুষের দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা প্রভৃতি ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই সকল শিল্পী শিল্পকলার ইতিহাসে এক বপ্লব সাধন করেন। এই সকল শিল্পীর কর্মতৎপরতার ফলে শিল্পের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় মানুষ ও প্রকৃতি। মানবতাবাদী শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন- লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্ছি (১৪৫২-১৫১৯)। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক, কবি এবং সঙ্গীতবিশারদ। তবে শিল্পী হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। শিল্পকলার দুটি শাখা- ভাস্কর্যকলা এবং চিত্রকলায় তিনি অবাধে বিচরণ করেছেন। তাঁর ’মোনালিসা’ এবং ইতালির মিলান গির্জার দেয়ালে অঙ্কিত ’শেষ ভোজ’ ছবি দুটি সারা পৃথিবীর চিত্র শিল্পীদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। অন্য বিখ্যাত শিল্পীরা হলেন র‌্যাফায়েল (১৪৮৩-১৫২০), মাইকেল এজ্ঞেলো (১৪৭৫-১৫৬৪), টিশিয়ান (১৪৭৭-১৪৭৬) প্রমুখ। র‌্যাফায়েলের ’কুমারি’ চিত্র এবং মাইকেল এঞ্জেলোর ’শেষ বিচার’ সারা পৃথিবীর শিল্প ভান্ডারের অমূল্য সম্পদ। এই সকল শিল্পীদের প্রয়াস ও প্রচেষ্টায় শিল্পের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় জীবন ও জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। তাঁদের কর্ম, চিন্তা এবং দর্শন আধুনিক শিল্পকলার ভিত্তি তৈরি করে।

ইতালির বাইরে রেনেসাঁসের বিস্তৃতির কারণ নিয়েও এক্ষেত্রে আলোচনা প্রয়োজন। ইতালিতে যে রেনেসাঁসের জন্ম হয় তা পঞ্চদশ শতাব্দীর পর ইউরোপের অন্য সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো পঞ্চদশ শতাব্দী জুড়ে ইউরোপের বিভিন্ন এলাকার ছাত্ররা ইতালিতে পড়তে আসতো এবং ইতালির বলগোনা অথবা পাদুয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। ইতালি থেকে আলপস পর্বত অতিক্রম করে কালেভদ্রে দু’চারজন ইতালীয় লেখক অথবা চিত্রশিল্পী ইউরোপের অন্য দেশে যেতেন। এই ভাবে যোগাযোগের ফলে ভাবের আদান -প্রদান ও নতুন চিন্তা-চেতনা বিকশিত হতে থাকে।

কিন্তু ১৫০০ সালের পরই অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীতেই উত্তর ইউরোপে শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক প্রসারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠে। কারণ এর মধ্যে ঐ অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থায়ীত্ব ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। ১৪৯৪ সালের পরে জ্ঞানের আদান-প্রদান আরো ব্যাপকতর হয়। কারণ ঐ সময় ইতালির মাটিতে ফ্রান্স এবং স্পেনের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ চলছিলো।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষ ইতালিয়ানদের কার্যক্রম সচক্ষে দেখার সুযোগ পায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন স্পেনীয় রাজার সৈন্যরা শুধু স্পেন থেকেই আসেনি তারা জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং বেলজিয়াম থেকেও এসেছিলো। অপরদিকে লিওনার্ডোর মতো ইতালীয় চিন্তাবিদেরা উত্তর ইউরোপের রাজা বা অভিজাতদের সৈন্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলো। এইভাবে ইতালীয় রেনেসাঁস এক সময় ইতালিতে দুর্বল হয়ে এলেও একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে জোরদার হয়ে উঠে।

ইউরোপের অন্যান্য দেশে রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য: ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিকশিত রেনেসাঁস ইতালির মত কোনোভাবেই একরকম এবং একই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল না। ইতালিতে রেনেসাঁস গড়ে উঠেছিলো ধর্মকে অস্বীকার করে, কিন্তু ইতালির বাইরে বিকশিত রেনেসাঁস ছিল ধর্ম কেন্দ্রিক। এর বড় কারণ হলো মধ্যযুগ থেকে ইতালি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করে আসছিলো। মধ্যযুগের শেষ দিকে ইতালির প্রাণবন্ত নগর জীবনে এক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা বিকশিত হয়। এর প্রভাবের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য চর্চা মিলিত হয়ে জন্ম হয়েছিলো নতুন এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার। ইউরোপের অপরাপর এলাকাগুলো ইতালির চেয়ে বাণিজ্য এবং শহর ভিত্তিক অর্থনীতির দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলো। ফ্লোরেন্স, ভেনিস এবং মিলান যে ভাবে চর্তুপাশের গ্রামাঞ্চলকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করত ইউরোপের কোনো শহর সেভাবে তা করতে পারতো না। এসব অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রিভ‚ত হচ্ছিল এমন সব রাজাদের হাতে যারা স্বেচ্ছায় যাজকদের শিক্ষাগত এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য মেনে নিচ্ছিল। ফলে ইউরোপের উত্তরাংশের দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত ধর্মশিক্ষায় বিশেষায়িত হয়ে উঠে। গির্জাগুলোই ছিল এসব দেশের প্রধান ইমারত।

সহজভাবে বলতে গেলে এসব অঞ্চলে রেনেসাঁস ছিল স্থানীয় ঐতিহ্যের ওপর ইতালীয় রেনেসাঁসের কিছু বৈশিষ্টের সংযোজন। উত্তর-ইউরোপের দেশগুলোতে রেনেসাঁস বলতে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তা ছিল আসলে খ্রিস্টান মানবতাবাদ বা খ্রিস্টান হিউম্যানিজম। ইতালীয় মানবতাবাদীদের মতো তাঁরাও বিশ্বাস করতেন যে, মধ্যযুগীয় দার্শনিক মতবাদ যুক্তিবিদ্যার চুলচেরা বিশ্লেষণে এমন ভাবে বন্দি হয়ে গেছে যে এর কোনো বাস্তব প্রায়োগিক মূল্য এখন আর নেই। কিন্তু ইতালীয় রেনেসাঁস পন্ডিতেরা যা করলেন তা উত্তর-ইউরোপীয়রা করলেন না, অর্থাৎ ইউরোপীয়রা বাইবেল, ধর্মীয় অনুশাসন, নীতিবাক্য ইত্যাদিকে বাস্তব জীবনের পথপ্রদর্শক হিসেবে নিলেন। ইতালীয় সমসাময়িকদের মতো তাঁরাও জ্ঞানের জন্য প্রাচীন যুগের দিকে তাকালেন, কিন্তু তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল খ্রিস্টান ঐতিহ্যের দিকে, গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলার দিকে নয়। ইতালির বাইরের ইউরোপের দেশগুলোতে শিল্পীরা ইতালীয় শিল্পীদের মতো মধ্যযুগীয় গোথিক শিল্প ধারাকে বর্জন করেন এবং এর পরিবর্তে প্রাচীন কলাকৌশল কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার জন্য চেষ্টা করলেন। তারপরও এ শিল্পীরা ইতালীয় শিল্পীদের তুলনায় প্রাচীন বিষয়বস্তু তাদের শিল্পের উপজীব্য হিসেবে খুব কমই ব্যবহার করেছেন। খ্রিস্টান মূল্যবোধের প্রতি ঐতিহ্যগত ভাবে বেশি দায়বদ্ধ থাকার কারণে তারা কখনো নগ্ন ছবি আঁকতে সাহস করেন নি।

পরিশেষে, মধ্যযুগীয় অরাজকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক কুসংস্কার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল নবজাগরণ। তবে নবজাগরণ কোন একটি ছোট্ট সময় সম্পন্ন হয়নি। একটি দীর্ঘ সময় ধরে এটি চলেছিল। নবজাগরণ মানুষকে ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আঙিনায় উপস্থিত করেছিল। নবজাগরণ প্রসূত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি যে উন্নতি লক্ষ্য করা যায় তাতে মানব সমাজ বহুগুণ সামনের দিকে এগিয়ে য়ায়। ইতালিতে শিল্প সাহিত্য ও চিত্রকলায় যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিলো তা ইউরোপের – বিশেষ করে উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ, ফরাসি কিম্বা জার্মান রেনেসাঁস কিন্তু ইতালীয় রেনেসাঁসের হুবহু প্রতিলিপি নয়। তথাপি, ইতালীয় রেনেসাঁসের কিছু দিক স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে আলাদা ভাবে বিকশিত হয়। ইতালির রেনেসাঁস ধর্মকে বাদ দিয়ে গড়ে উঠলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ইরাসমাস, থমাস ম্যুর, রেবেলেয়াস প্রমুখ মানবতাবাদী ধর্মকে কেন্দ্র করেই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁদের লেখনি চূড়ান্ত পর্যায়ে মার্টিন লুথারের প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনকেই সহযোগিতা করেছে। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার গুলি মানব সমাজকে বহু দিক থেকে উন্নত করে তোলে। তাই আধুনিকতায় উত্তোরনের ক্ষেত্রে নবজাগরণের অবদানকে সর্বদাই স্বীকার করে নিতে হয়।

বিশদ এই লেখাটির তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, ‘আধুনিক ইউরোপ – জীবন মুখোপাধ্যায়’; ‘আধুনিক ইউরোপের রূপরেখা – জি কে পাহাড়ী’; ‘আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন – বাসবেন্দ বসু’; ‘উত্তোরনের পথে ইউরোপ – পুলকেশ রায়’ সহ প্রভৃতি নিবন্ধ ও গবেষণাকর্ম।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগ:

ইতালিতে রেনেসাঁস এর উদ্ভব ও বিস্তার

প্রকাশ: ১২:১৫:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

নওশীন নাওয়ার রাফা: ইংরেজি ‘রেনেসাঁ’ (ফরাসি: Renaissance, ইতালীয়: Rinascimento) শব্দের অর্থ নবজাগরণ বা পুনর্জন্ম। ধর্মভাবনা নিয়ন্ত্রিত ও সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় দীর্ঘ বদ্ধ দশা থেকে মুক্ত হয়ে নতুনভাবে জীবনের সবকিছুকে জানার জন্য মানব মনের যে আকুলতা, অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার জন্য যে ঐকান্তিক আগ্রহ তারই পরিণতি স্বরূপ যে নবজীবনবাদের সূচনা- তাকেই সাধারণভাবে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ নামে আখ্যায়িত করা হয়। গোটা বিষয়টির আদ্যোপান্ত ব্যাপক বিস্তৃত ও সুগভীর হলেও এই লেখনীটিতে মূলত রেনেসাঁস এর উৎপত্তিস্থল ইতালি ও সেখানে নবজাগরণের বিস্তার সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।

মধ্যযুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশ্বাস সব কিছুই আবর্তিত হতো প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে। অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত এবং কুসংস্কারের মায়াজালে আবদ্ধ মানুষ নিরুপায় ভাবেই এই নিয়ম মেনে চলতো। কিন্তু ইউরোপে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতক থেকে ক্রমেই এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সাধারণ মানুষ যুক্তিতর্ক দ্বারা সবকিছুকে গ্রহণ বা বর্জন করতে উৎসাহী হয়ে ওঠে। সবকিছুকেই যাচাই করতে শেখে মানুষ। মানব মনের এই পরিবর্তন বা উন্নয়নই নবজাগরণ বা রেনেসাঁস।

মানব সভ্যতার ইতিহাস অতীত থেকে বর্তমান এবং বর্তমান থেকে আগামীর পথে এগিয়ে চলেছে। সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি আর অর্থনীতি ইতিহাসের কালের পরিসীমায় আবদ্ধ। ইতিহাসে কোনো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি একই ভাবে কিম্বা একই পন্থায় কিম্বা ধারায় ঘটে না। রেনেসাঁস মূলত একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাজ পরিবর্তন প্রক্রিয়া। এই রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার উত্থান ঘটেছে, একই সঙ্গে অবসান ঘটে মধ্যযুগের। সে কারণেই রেনেসাঁসকে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না; এর ভিতরগত এবং বাহ্যিক মর্ম অত্যন্ত ব্যাপক।

প্রচলিত অর্থে রেনেসাঁসের বলতে বুঝায় প্রাচীন যুগের গ্রেকো- রোমান সংস্কৃতির পুনরুত্থান তথা প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ভাস্কর্যকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করে সত্য সুন্দরকে গ্রহণ করা, এর ভিত্তিতে জীবনকে পরিচালনা করা। তবে সংজ্ঞাটির প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো শুধুমাত্র প্রাচীন জ্ঞান বিজ্ঞান অধ্যয়ন এবং প্রয়োগ মানুষের দৃষ্টিভিঙ্গ গঠনে সহায়ক হলেও সামগ্রিক সমাজ বদলের প্রধান কারণ হতে পারে না।

রেনেসাঁসের প্রচলিত সংজ্ঞার প্রায় বিপরীতে আধুনিক সংজ্ঞাটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আধুনিক ইতিহাসবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে মধ্যযুগের সামন্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর স্থবিরতার অবসান ঘটিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্মেষ ও বিকাশের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমাজ জীবনে যে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা ঘটে-এটাই রেনেসাঁস বা নবজাগরণ। উক্ত নব জীবনের আলোকে ইউরোপের মানুষ তাদের অতীত ঐতিহ্য তথা গ্রিক ও রোমান যুগের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা প্রভৃতি পাঠে মনোনিবেশ করার মাধ্যমে জীবন ও জগতকে যুগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ হবে। আর এভাবেই শুরু হয় ইউরোপের ইতিহাসে এক নতুন পর্ব। পর্বটির উত্তরণ ঘটেছিল সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা-সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে। পঞ্চদশ শতকের ইউরোপের রেনেসাঁসকে প্রকৃত অর্থেই ইউরোপের ইতিহাসে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার এক অবস্থান থেকে গুণগতভাবে অন্য এক উত্তরণশীল পর্ব হিসেবে অভিহিত করা যায়।

সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগ থেকে বাণিজ্যিক ধনতন্ত্রে উত্তরণের আর্থসামাজিক পটভূমিতে যে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল, সেটিই ইতিহাসে রেনেসাঁস হিসেবে বিখ্যাত। চার্চশাসিত ভূমিনির্ভর মধ্যযুগীয় সমাজ রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি, অলৌকিকতার পরিবর্তে ইহজাগতিকতা, ধর্মীয় আচারের পরিবর্তে মানবমুখিতা ও সৌন্দর্যচর্চা প্রাধান্য পায়। মানুষ’ই হয়ে ওঠে সবকিছুর মানদণ্ড। রেনেসাঁসের এটিই প্রথম প্রকাশ, যার মূল প্রত্যয় ছিল মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলা। সভ্যতার অগ্রযাত্রায় ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে নতুন যুগের আদর্শ হিসেবে রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটে, যা অলৌকিক ও দৈবের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করে তাকে ‘মানুষ’ করে তুললো।

ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, রেনেসাঁসের পীঠস্থান ইতালি। মূলত ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষাংশে (মতান্তরে, ১২৮০ হতে) ইতালিতে রেনেসাঁস এর গোড়াপত্তন ঘটে। পরবর্তী সময়ে জার্মানিতে রিফরমেশন, ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব, ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে রুশ বিপ্লব ও চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে। তবে যেহেতু ইতালিতেই প্রথম রেনেসাঁস এর উদ্ভব, সেহেতু, ইতালি পর্বের রেনেসাঁসকে রেনেসাঁসের আদি পর্ব বা রেনেসাঁসের প্রথম পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

তবে নবজাগরণের প্রকৃত সূচনাকাল সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। সাধারণভাবে মনে করা হয় পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের গোড়ায় নবজাগরণের সূচনা হয়েছে। কিন্তু ভাব জাগতিক পরিবর্তনকে কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা দ্বারা বেঁধে দেওয়া সম্ভব নয়। চেতনার বিকাশ ঘটে ধীরলয়ে ক্রমান্বয়ে। একটি বোধ থেকে জন্ম নেয় আরেকটি বোধ। তাই কিছু পন্ডিত মনে করেন পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নবজাগরণের সুর ধ্বনিত হলেও তার প্রস্তুতি চলছিল আরো কয়েকশো বছর আগে থেকেই।

রেনেসাঁসে মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার অতুলনীয় বিস্ফোরণ ঘটে। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ইতালিতে রেনেসাঁসের উজ্জ্বল সূচনা ও অসামান্য বিকাশ ঘটেছিল। মধ্যযুগে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছিল কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। রেনেসাঁস সে স্থানে অধিষ্ঠিত করে সংস্কৃতিকে। বেকন ও গ্যালিলিওর প্রভাবে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় ভূমিকায়। মানবসভ্যতার এই ধারাবাহিক অগ্রগতির যাত্রাবিন্দু হচ্ছে রেনেসাঁস। তাই রেনেসাঁসকে বলা হয়েছে ‘মানব সভ্যতার প্রথম বসন্ত।’

ইতালীয় রেনেসাঁসকে রেনেসাঁসের আদি পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই রেনেসাঁস ইতালিতে শুরু হওয়ার কয়েকটি কারণ বিদ্যমান ছিল। সেগুলো যথাক্রমে, প্রথমত, ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান। ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তী দেশ হওয়ার কারণে মধ্যযুগে ইতালি ব্যবসা-বাণিজ্যে ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে অগ্রগামী ছিল। উপরন্তু সাগর তীরবর্তী অবস্থানের কারণে ইউরোপের মূল ভূখন্ডের সামন্ত আর্থ-সামাজিক কাঠামো ইতালিকে ততটা প্রাভাবিত করেনি। ফলে রেনেসাঁস সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি এখানে বিরাজমান ছিল।

দ্বিতীয়ত, ইতালীয়রা বরাবরই প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারক বাহক ছিলেন। এই প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহ্য তাদেরকে নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

তৃতীয়ত, ইতালির ধর্মাধিষ্ঠানসমূহ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র। এই জন্য দেখা যায় যে প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহে পোপগণ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছেন। এটাও ইতালিতে রেনেসাঁস শুরুর অন্যতম কারণ।

চতুর্থত, ইতালি ছিল বিভিন্ন জাতির মিলন ক্ষেত্র। এখানে ফ্রাঙ্ক, জার্মান, নর্মান, গথ প্রভৃতি জাতি বসবাস করতো। এই বহু জাতির সহাবস্থানের ফলে এখানকার সামাজিক জীবনে সহমর্মিতা বিরাজ করতো। এই জন্য ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পন্ডিতেরা এখানে আগমন করেছিলেন।

তবে, যদিও ইতালিতে রেনেসাঁস শুরু হয়, তথাপি কালক্রমে আল্পস পর্বত অতিক্রম করে এর প্রভাব বিস্তৃত হতে থাকে এবং স্থানীয় শিল্প, সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়। সে জন্য এই সব রেনেসাঁস ফরাসি রেনেসাঁস, ইংরেজ রেনেসাঁস, জার্মান রেনেসাঁস ইত্যাদি নামে পরিচিত হতে শুরু করে।

নবজাগরণের মতো এত বড় বিষয় কোন ক্ষুদ্র প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হওয়া সম্ভব ছিলনা। তাই নবজাগরণের কারণ সু-বিস্তৃতভাবে আলোচনা সাপেক্ষ। সেগুলোর কয়েকটি যথাক্রমে:

মুদ্রণ যন্ত্রের প্রভাব: পঞ্চদশ শতকে জার্মানির গুটেনবার্গ নামক জনৈক ব্যক্তি মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার করলে সাহিত্যের বাণী সহজেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গুণী ব্যক্তিদের মতাদর্শের সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটতে শুরু করে। কবি সাহিত্যিক দার্শনিক বিজ্ঞানীর মৌখিক চিন্তাভাবনা পুস্তকে ছাপা হলে তা সহজেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। নবজাগরণ দূত রূপে ছাপাখানার অবদান তাই অনস্বীকার্য। এছাড়া, ইতালিতে তারও প্রায় শ-খানেক বছর পূর্বেই সাহিত্যে নবজোয়ার আসে এবং মানুষের মননে পরিবর্তন শুরু হয়।

ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড: ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের কারণে প্রাচ্য সভ্যতার সাথে পাশ্চাত্য সভ্যতার পরিচয় ঘটে। পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা প্রাচ্যে এসে এখানকার ভোগবাদী জীবন দর্শনের সাথে পরিচিত হন। প্রাচ্যের মানুষের বিলাস পূর্ণ জীবন যাপন পদ্ধতি পাশ্চাত্যের ধর্মযোদ্ধাদের আকৃষ্ট করে। গির্জার কঠোর জীবন যাপন পদ্ধতির প্রতি এরা বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে এরাই  নতুন জীবন দর্শন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। যার পরিণতি নবজাগরণ।

নগরের ভূমিকা: নবজাগরণের জন্য এককভাবে ইতালির বহুমুখী অবদান রয়েছে। ইতালিতে নগর জীবনের সূচনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যবসা বাণিজ্য ভিত্তিক নগর গুলি প্রচলিত গ্রামীণ জীবনের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করায় তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্র ধরেই গ্রিক ও আরবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় ঘটে ইতালির নগর গুলির। এভাবে গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে ইতালি। আর একই পথে ইতালির পর জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সূচনা ঘটে নবজাগরণের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান: পঞ্চদশ শতকের বহু আগে থেকেই ইতালিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সূচনা ঘটে। বোলোনা, মিলান, রেভিনা এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানপিপাসু ছাত্রদের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে। ক্রমে প্যারি, অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ সহ বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে প্রকৃত বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং নবজাগরণের পথ প্রশস্ত হয়।

সাহিত্যে নবজাগরণ: মধ্যযুগের সাহিত্য ও শিল্প চর্চা ছিল ধর্মভিত্তিক ও গির্জা কেন্দ্রিক। নবজাগরণ ও মানবতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা বহন করে আনে। নতুন যুগের সাহিত্যে মানুষ বস্তুজগৎ ও প্রকৃতির কথা বলা হয়েছে। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নদী-পাহাড়, চন্দ্র-সূর্য এরাই হলো এ যুগের সাহিত্যের উপজীব্য। গির্জার নিয়ন্ত্রণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি হলো এ যুগের সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য।

ইতালির নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা মহাকবি দান্তে ল্যাটিন ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেন। তাঁর রচিত ‘ডিভাইন কমেডি’ ইতালীয় ভাষায় রচিত এক অমর সৃষ্টি। এই কাব্যে মধ্যযুগীয় জীবনধারা সমালোচনা মানুষের প্রেম-ভালোবাসা দেশপ্রেম প্রাকৃতিক ঘটনা এবং সর্বোপরি স্বাধীন সংঘবদ্ধ ইতালির জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁকে ‘ইতালির নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়। ফ্রান্সেস্কো পেত্রার্ক ছিলেন ফ্লোরেন্সের অধিবাসী। তিনি ছিলেন এযুগের মানবতাবাদ এর প্রবর্তক এবং এ যুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ মনীষী। তিনি হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্যের অনুবাদ করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘সনেটস টু লরা’।

বোকাচ্চিও ছিলেন ইতালির গদ্য সাহিত্যের জনক। তাঁর রচিত ‘ডেকামেরন’ নামক জীবনমুখী কাব্যটি সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এই গ্রন্থে সমাজের নানান জটিল ব্যবস্থা , যাজক ও অভিজাতদের দুর্নীতি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি সাধারণ মানুষের আনন্দ, ভালোবাসা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা ফুটে উঠেছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক- কবি -রাজনীতিবিদ মেকিয়াভেলি-র ‘দ্য প্রিন্স’ নামক গ্রন্থটি অবিস্মরনীয়। তাঁর মতে রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্ম ,নৈতিকতার ন্যায় অন্যায় বলে কিছু নেই। তাঁকে ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক’ বলা হয়।

মধ্যযুগে ফ্রান্সে ট্রুবাদুর নামে একদল ভ্রাম্যমান গীতিকবির আবির্ভাব হয়। তাঁরা গীতি কবিতার মাধ্যমে গির্জা ও যাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। জিওফ্রে চসার ছিলেন ইংল্যান্ডের অপর একজন বিখ্যাত কবি । তিনি ইংরেজি কাব্যের জনক নামে পরিচিত। সাহিত্য ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। স্যার ফ্রান্সিস বেকন মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে যুক্তি তর্কের দ্বারা সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাকে ইংরেজি দর্শনের আদি গুরু বলা হয়।ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে উয়িলিয়াম শেক্সপিয়র আবির্ভূত হন। ম্যাকবেথ,হ্যামলেট,জুলিয়াস সিজার,মার্চেন্ট অফ ভেনিস প্রভৃতি তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।

শিল্পে নবজাগরণ: জিয়োটো ছিলেন চতুর্দশ শতকের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। তাকে চিত্রাঙ্কনে নবজাগরণের আদি রূপকার বলা চলে। চিত্রশিল্পী বত্তিচেলি মানুষের প্রেম, দুঃখ,প্রবঞ্চনা প্রভৃতি বাস্তব রূপ নিয়ে শিল্পকর্ম করেছেন। তার ‘দি বার্থ অফ ভেনাস’ চিত্রটি অবিস্মরনীয়। ভেনিসের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী টিশিয়ান প্রায় সাতশ চিত্র অঙ্কন করেন। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী। তার অঙ্কিত ‘মোনালিসা’ ও ‘শেষ ভোজ’ চিত্রটি আজও মানুষের বিষ্ময়ের উৎপাদন করে। ইতালির বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও স্থপতি রাফায়েল এ যুগের আরেক বিস্ময়। তিনি ছিলেন ষোড়শ শতকের শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী। তার অঙ্কিত ‘ম্যাডোনা’ বা মাতৃমূর্তি অর্থাৎ মাতা মেরীর চিত্র গুলির চিত্র শিল্পের ইতিহাসে বিস্ময়কর সৃষ্টি। সমকালীন পোপ ও যাজকরা তাকে শ্রেষ্ঠ চিত্রকর বলে সম্মান জানাতেন। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর মাইকেল এঞ্জেলোর নতুন নতুন ভাবনায় চিত্রাঙ্কন মানুষের মনে জায়গা করে নেয়। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল ‘শেষ বিচার’ নামক বিখ্যাত ছবিটি। রোমের সেন্ট পিটার্স গির্জা তৈরির ব্যাপারে তার শিল্প দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।

বিজ্ঞানে নবজাগরণ: রজার বেকন ছিলেন নবজাগরণ যুগের অন্যতম বিজ্ঞানী। তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হত। তিনি পদার্থবিদ্যা, আলোক বিজ্ঞান, রসায়ন প্রভৃতি নানা শাস্ত্রে বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় রাখেন। এই কারণে তাঁকে ‘বিস্ময়কর ডাক্তার’ বলা হয়। চশমার কাঁচ, অণুবীক্ষণ- দূরবীক্ষণ যন্ত্র এবং বারুদের আবিষ্কারে তার অসামান্য অবদান ছিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘ওপাশ মাজুস’।

ইংল্যান্ডের আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন ফ্রান্সিস বেকন। প্রকৃতি বিজ্ঞান চর্চায় তার প্রবল উৎসাহ ছিল। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘নোভাম অর্গানাম’। বিজ্ঞান চর্চায় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিশেষ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আধুনিক পদ্ধতিতে খাল খনন ও দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি দেখিয়েছেন।

কোপার্নিকাস জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি প্রমাণ করেন যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘অন দ্যা রিভলিউশন অফ সেলেস্টিয়াল অর্ডার’। গ্যালিলিও ছিলেন একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি দেখা সম্ভব হয় তাঁর জন্যই। গুটেনবার্গ ছিলেন সর্বপ্রথম মুদ্রণ যন্ত্র ও সীসার অক্ষরের সাহায্যে বই ছাপার পদ্ধতির আবিষ্কারক।

ইতালিতে রেনেসাঁস সংঘটিত হওয়ার পেছনে অন্যান্য অনুঘটকসমূহ নিয়েও এক্ষেত্রে আলোচনা করা যেতে পারে। সেগুলো যথাক্রমে,

আরবীয় সভ্যতার প্রভাব: ইউরোপে রেনেসাঁস সৃষ্টির পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে আরবীয় সভ্যতার প্রভাবকে অভিহিত করা যায়। মধ্যযুগের সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী সভ্যতা হলো আরবীয় সভ্যতা। হযরত মোহাম্মদের (সঃ) আগমনের ভেতর দিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরে অন্ধকারে নিমজ্জিত আরব জনগোষ্ঠী জেগে উঠে। ইসলামের মহান সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা, অধিকার, জ্ঞান সাধনা, মানবতাবোধ, ধৈর্য ও সাহসকে ধারণ করে অল্প সময়ের মধ্যে আরবরা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর পরলোকগমনের শতাব্দীকালের মধ্যেই আরবরা সমগ্র পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল, মধ্য এশিয়া, ভারতবর্ষ, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের স্পেন দখল করে। এই বিজয়ের পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতেও আরবদের অসাধারণ সাফল্য সমগ্র বিশ্বকে অবাক করে দেয়। আব্বাসীয় শাসনামলে শুরু হয় আরবদের জ্ঞান সাধনার ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ। বিশেষত সাহিত্য, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি জ্ঞানের মৌলিক শাখায় আরবদের অবদান ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। একাদশ শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ক্রুসেড অভিযানের সময় ইউরোপীয়রা আবরবদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্সে আসে। আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপবাসীকে জাগ্রত করতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। এইভাবে আরব সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপের রেনেসাঁস সৃষ্টিতে পালন করে এক ইতিবাচক ভূমিকা।

জীবন ও জগতের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গী: ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ইতালির মানুষের জীবন ও জগতের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গী। মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মীয় শাসন ও শোষণের ফলে মানুষের চিন্তার কোনো প্রকার স্বাধীনতা ছিল না। চর্তুদশ শতক থেকে সামন্তবাদী আর্থ-সামাজিক কাঠামো দুর্বল হয়ে আসার পটভ‚মিতে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। এই সময় থেকে পোপতন্ত্রের প্রভাব এবং ধর্মীয় অনুশাসন সমাজ জীবনে দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে জীবন ও জগতের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন হতে থাকে। অজানাকে জানার এবং অচেনাকে চেনার জন্য মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহ জাগ্রত হয়। মানুষ যুক্তি এবং বুদ্ধি দিয়ে দেশ ও সমাজকে বিচার করতে শুরু করে। ইতিহাসের এই প্রক্রিয়া ইউরোপে নবজাগরণে এক ইতিবাচক ভ‚মিকা পালন করে।

নতুন সাহিত্যের বিকাশ: ইউরোপের রেনেসাঁস সৃষ্টিতে নতুন সাহিত্যের বিকাশ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এইক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন ইতালির চারণ কবিগণ। তারা রাজা আর্থার, শার্লামেন, হোলি গ্রেল প্রমুখদের উপর গীতি রচনা করে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলন করেন। স্পেনের কবিরা এক ধরনের লোকজ ঐতিহ্যাশ্রয়ী কবিতা রচনা শুরু করে। এই ধরনের কবিতাকে বলা হতো সিড। ইতালির কবি দান্তে তার রচিত ’ডিভাইন এন্ড কমেডি’ নামক গ্রন্থে ইতালির কথ্য ভাষাকে সাহিত্য রচনার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইংল্যান্ডে চ্যসার ‘কেন্টারবেরি টেলস’ গ্রন্থে রোমান ও স্যাকসন ভাষার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে আধুনিক ইংরেজি ভাষার প্রকৃত রূপদান করেন। এই ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ইউরোপের রেনেসাঁসকে নতুন গতি দান করেছিল।

ইতালির শহরগুলোর অবদান: ইতালি তথা ইউরোপে রেনেসাঁ সৃষ্টিতে ইতালীর শহরগুলোর অবদান অবশ্যই স্মরণীয়। ইতালির দক্ষিণ অঞ্চল ভূমধ্যসাগরীয় তীরবর্তী। এই অঞ্চলে এর বাণিজ্য শহরগুলি গড়ে উঠেছিল। এই শহরগুলোর অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল বাণিজ্য। বাণিজ্যের প্রয়োজনে এই শহরগুলিতে গড়ে উঠে ছোট ছোট কারখানা। ইউরোপের সামন্তবাদী আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রভাব সাগর তীরবর্তী এই শহরগুলোতে খুবই দুর্বল ছিল। ফলে এই শহরগুলিতে স্বাধীন চিন্তা – চেতনা, ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং নাগরিক আদর্শ সৃষ্টির এক অনুকূল পরিবেশ ছিল বিরাজমান। উপরন্তু মানুষের ত্মনির্ভরশীল হওয়ার মত সুযোগ এখানে বর্তমান ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবে মানুষের মন ও মানসিকতায় উদারনৈতিক ভাবনা, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী, সাহিত্য, শিল্পকলার প্রতি গভীর আকর্ষণের সৃষ্টি হয়েছিল। বস্তুত জেনোয়া, ফ্লোরেন্স, ভেনিস প্রভৃতি শহর ইউরোপে রেনেসাঁস সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল।

মানবতাবাদী লেখকদের অবদান: ইতালিতে রেনেসাঁসের পেছনে মানবতাবাদী পন্ডিতদের অবদান অপরিসীম। জ্ঞানের সাধক এই সকল পন্ডিতেরা মানুষের সামগ্রিক কল্যানের জন্য, মানুষকে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। অতীত যুগের ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি অধ্যয়ন করে অর্জিত জ্ঞান সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করা ছিল তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। জ্ঞান জগতে তাদের বিচরণ ছিল খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক চিন্তা ভাবনার বাইরে প্রধানত গ্রিক ও রোমান শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান ও এবং দর্শনে। চিন্তা ও মননে এই সকল পন্ডিত ছিলেন উদারনৈতিক, সহনশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ। তাদের একটি প্রধান কাজ ছিল প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও প্রচার করা। মানবতাবাদী পন্ডিতদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রেত্রার্ক এবং বোক্কাচো।

ফ্রান্সিস পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪): ইতালির মানবতাবাদী পন্ডিতদের মাঝে প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন ফ্রান্সিস পেত্রার্ক (১৩০৪-১৩৭৪) । তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য জানা যায় না। তিনি অনেক পরিশ্রম করে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান যুগের প্রায় দুইশত পান্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। বিশেষত তাঁর সংগৃহীত প্লেটোর গ্রন্থাবলী এবং হোমারের মহাকাব্য তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করে। ইতালির শত শত তরুণ প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষা ছেড়ে দিয়ে পেত্রার্কের শীষ্যত্ব গ্রহণ করে। ফলে জ্ঞান বিজ্ঞানে এক প্রবল যুক্তিবাদের ধারার সৃষ্টি হয়। প্রেত্রার্কের জ্ঞান সাধনার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে তিনি তরুণদের মনে নতুন নতুন জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন। তিনি সনেট নামক চৌদ্দ লাইনের কবিতারও জনক। এই কবিতার ধারা পরবর্তীকালে পৃথিবীর সব সাহিত্যের কবিদের কমবেশি প্রভাবিত করেছে।

বোক্কাচো (১৩১৩-১৩৭৫): এই সময়ের একজন অন্যতম মানবতাবাদী লেখক হলেন গিওভান্নি বোক্কাচো (১৩১৩- ১৩৭৫)। তিনি ইতালির গদ্য সাহিত্যের জনক। তাঁর লিখিত ’ডেকামেরেন’ গ্রন্থ ইতালির গদ্য সাহিত্যের পথ প্রদর্শকের ভ‚মিকা পালন করেছে। তিনি গ্রিক ভাষা শিক্ষা করেন এবং মহাকবি হোমারের দুটি মহাকাব্য ’ইলিয়ড’ ও ’ওড়েসা’ লাতিন ভাষায় অনুবাদ করেন। বোক্কাচোর আরেকটি কৃতিত্ব হলো গ্রিক ও রোমান যুগের প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ এবং এগুলির কপি প্রস্তুত করে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা। মানুষের কর্মকান্ডের ওপর গভীরভাবে আস্থাশীল, মানুষের অমিত সম্ভাবনা শক্তিতে বিশ্বাসী বোক্কাচোর লেখনী ও চিন্তাধারা ইতালির তরুণদেরকে গভীরভাবে আন্দোলিত করেছিল।

মানবতাবাদী শিল্পীদের অবদান: পঞ্চদশ শতকের মানবতাবাদী শিল্পীরা রেনেসাঁসের সৃষ্টি এবং বিকাশে এক অভ‚তপূর্ব ভ‚মিকা পালন করেছিল। মধ্যযুগের শিল্পকলার বিষয়বস্তু ছিল ঈশ্বর এবং যিশু। মানবতাবাদী শিল্পীদের শিল্পকার্যের বিষয়বস্তু ছিল মানুষ ও পৃথিবীতে মানুষের জীবন। পৃথিবীতে মানুষের দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা প্রভৃতি ফুটিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই সকল শিল্পী শিল্পকলার ইতিহাসে এক বপ্লব সাধন করেন। এই সকল শিল্পীর কর্মতৎপরতার ফলে শিল্পের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় মানুষ ও প্রকৃতি। মানবতাবাদী শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন- লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্ছি (১৪৫২-১৫১৯)। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক, কবি এবং সঙ্গীতবিশারদ। তবে শিল্পী হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। শিল্পকলার দুটি শাখা- ভাস্কর্যকলা এবং চিত্রকলায় তিনি অবাধে বিচরণ করেছেন। তাঁর ’মোনালিসা’ এবং ইতালির মিলান গির্জার দেয়ালে অঙ্কিত ’শেষ ভোজ’ ছবি দুটি সারা পৃথিবীর চিত্র শিল্পীদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। অন্য বিখ্যাত শিল্পীরা হলেন র‌্যাফায়েল (১৪৮৩-১৫২০), মাইকেল এজ্ঞেলো (১৪৭৫-১৫৬৪), টিশিয়ান (১৪৭৭-১৪৭৬) প্রমুখ। র‌্যাফায়েলের ’কুমারি’ চিত্র এবং মাইকেল এঞ্জেলোর ’শেষ বিচার’ সারা পৃথিবীর শিল্প ভান্ডারের অমূল্য সম্পদ। এই সকল শিল্পীদের প্রয়াস ও প্রচেষ্টায় শিল্পের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় জীবন ও জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। তাঁদের কর্ম, চিন্তা এবং দর্শন আধুনিক শিল্পকলার ভিত্তি তৈরি করে।

ইতালির বাইরে রেনেসাঁসের বিস্তৃতির কারণ নিয়েও এক্ষেত্রে আলোচনা প্রয়োজন। ইতালিতে যে রেনেসাঁসের জন্ম হয় তা পঞ্চদশ শতাব্দীর পর ইউরোপের অন্য সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পুরো পঞ্চদশ শতাব্দী জুড়ে ইউরোপের বিভিন্ন এলাকার ছাত্ররা ইতালিতে পড়তে আসতো এবং ইতালির বলগোনা অথবা পাদুয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। ইতালি থেকে আলপস পর্বত অতিক্রম করে কালেভদ্রে দু’চারজন ইতালীয় লেখক অথবা চিত্রশিল্পী ইউরোপের অন্য দেশে যেতেন। এই ভাবে যোগাযোগের ফলে ভাবের আদান -প্রদান ও নতুন চিন্তা-চেতনা বিকশিত হতে থাকে।

কিন্তু ১৫০০ সালের পরই অর্থাৎ ষোড়শ শতাব্দীতেই উত্তর ইউরোপে শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক প্রসারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠে। কারণ এর মধ্যে ঐ অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থায়ীত্ব ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। ১৪৯৪ সালের পরে জ্ঞানের আদান-প্রদান আরো ব্যাপকতর হয়। কারণ ঐ সময় ইতালির মাটিতে ফ্রান্স এবং স্পেনের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ চলছিলো।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মানুষ ইতালিয়ানদের কার্যক্রম সচক্ষে দেখার সুযোগ পায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন স্পেনীয় রাজার সৈন্যরা শুধু স্পেন থেকেই আসেনি তারা জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ডেনমার্ক এবং বেলজিয়াম থেকেও এসেছিলো। অপরদিকে লিওনার্ডোর মতো ইতালীয় চিন্তাবিদেরা উত্তর ইউরোপের রাজা বা অভিজাতদের সৈন্য হিসেবে যোগ দিয়েছিলো। এইভাবে ইতালীয় রেনেসাঁস এক সময় ইতালিতে দুর্বল হয়ে এলেও একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমান্বয়ে জোরদার হয়ে উঠে।

ইউরোপের অন্যান্য দেশে রেনেসাঁসের বৈশিষ্ট্য: ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিকশিত রেনেসাঁস ইতালির মত কোনোভাবেই একরকম এবং একই বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিল না। ইতালিতে রেনেসাঁস গড়ে উঠেছিলো ধর্মকে অস্বীকার করে, কিন্তু ইতালির বাইরে বিকশিত রেনেসাঁস ছিল ধর্ম কেন্দ্রিক। এর বড় কারণ হলো মধ্যযুগ থেকে ইতালি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য লালন করে আসছিলো। মধ্যযুগের শেষ দিকে ইতালির প্রাণবন্ত নগর জীবনে এক ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা বিকশিত হয়। এর প্রভাবের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য চর্চা মিলিত হয়ে জন্ম হয়েছিলো নতুন এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার। ইউরোপের অপরাপর এলাকাগুলো ইতালির চেয়ে বাণিজ্য এবং শহর ভিত্তিক অর্থনীতির দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিলো। ফ্লোরেন্স, ভেনিস এবং মিলান যে ভাবে চর্তুপাশের গ্রামাঞ্চলকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করত ইউরোপের কোনো শহর সেভাবে তা করতে পারতো না। এসব অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রিভ‚ত হচ্ছিল এমন সব রাজাদের হাতে যারা স্বেচ্ছায় যাজকদের শিক্ষাগত এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য মেনে নিচ্ছিল। ফলে ইউরোপের উত্তরাংশের দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত ধর্মশিক্ষায় বিশেষায়িত হয়ে উঠে। গির্জাগুলোই ছিল এসব দেশের প্রধান ইমারত।

সহজভাবে বলতে গেলে এসব অঞ্চলে রেনেসাঁস ছিল স্থানীয় ঐতিহ্যের ওপর ইতালীয় রেনেসাঁসের কিছু বৈশিষ্টের সংযোজন। উত্তর-ইউরোপের দেশগুলোতে রেনেসাঁস বলতে যে আন্দোলন গড়ে উঠে তা ছিল আসলে খ্রিস্টান মানবতাবাদ বা খ্রিস্টান হিউম্যানিজম। ইতালীয় মানবতাবাদীদের মতো তাঁরাও বিশ্বাস করতেন যে, মধ্যযুগীয় দার্শনিক মতবাদ যুক্তিবিদ্যার চুলচেরা বিশ্লেষণে এমন ভাবে বন্দি হয়ে গেছে যে এর কোনো বাস্তব প্রায়োগিক মূল্য এখন আর নেই। কিন্তু ইতালীয় রেনেসাঁস পন্ডিতেরা যা করলেন তা উত্তর-ইউরোপীয়রা করলেন না, অর্থাৎ ইউরোপীয়রা বাইবেল, ধর্মীয় অনুশাসন, নীতিবাক্য ইত্যাদিকে বাস্তব জীবনের পথপ্রদর্শক হিসেবে নিলেন। ইতালীয় সমসাময়িকদের মতো তাঁরাও জ্ঞানের জন্য প্রাচীন যুগের দিকে তাকালেন, কিন্তু তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল খ্রিস্টান ঐতিহ্যের দিকে, গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলার দিকে নয়। ইতালির বাইরের ইউরোপের দেশগুলোতে শিল্পীরা ইতালীয় শিল্পীদের মতো মধ্যযুগীয় গোথিক শিল্প ধারাকে বর্জন করেন এবং এর পরিবর্তে প্রাচীন কলাকৌশল কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার জন্য চেষ্টা করলেন। তারপরও এ শিল্পীরা ইতালীয় শিল্পীদের তুলনায় প্রাচীন বিষয়বস্তু তাদের শিল্পের উপজীব্য হিসেবে খুব কমই ব্যবহার করেছেন। খ্রিস্টান মূল্যবোধের প্রতি ঐতিহ্যগত ভাবে বেশি দায়বদ্ধ থাকার কারণে তারা কখনো নগ্ন ছবি আঁকতে সাহস করেন নি।

পরিশেষে, মধ্যযুগীয় অরাজকতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক কুসংস্কার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল নবজাগরণ। তবে নবজাগরণ কোন একটি ছোট্ট সময় সম্পন্ন হয়নি। একটি দীর্ঘ সময় ধরে এটি চলেছিল। নবজাগরণ মানুষকে ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে বের করে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আঙিনায় উপস্থিত করেছিল। নবজাগরণ প্রসূত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি যে উন্নতি লক্ষ্য করা যায় তাতে মানব সমাজ বহুগুণ সামনের দিকে এগিয়ে য়ায়। ইতালিতে শিল্প সাহিত্য ও চিত্রকলায় যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিলো তা ইউরোপের – বিশেষ করে উত্তর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ, ফরাসি কিম্বা জার্মান রেনেসাঁস কিন্তু ইতালীয় রেনেসাঁসের হুবহু প্রতিলিপি নয়। তথাপি, ইতালীয় রেনেসাঁসের কিছু দিক স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে আলাদা ভাবে বিকশিত হয়। ইতালির রেনেসাঁস ধর্মকে বাদ দিয়ে গড়ে উঠলেও ইউরোপের অন্যান্য দেশে ইরাসমাস, থমাস ম্যুর, রেবেলেয়াস প্রমুখ মানবতাবাদী ধর্মকে কেন্দ্র করেই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তাঁদের লেখনি চূড়ান্ত পর্যায়ে মার্টিন লুথারের প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনকেই সহযোগিতা করেছে। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার গুলি মানব সমাজকে বহু দিক থেকে উন্নত করে তোলে। তাই আধুনিকতায় উত্তোরনের ক্ষেত্রে নবজাগরণের অবদানকে সর্বদাই স্বীকার করে নিতে হয়।

বিশদ এই লেখাটির তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, ‘আধুনিক ইউরোপ – জীবন মুখোপাধ্যায়’; ‘আধুনিক ইউরোপের রূপরেখা – জি কে পাহাড়ী’; ‘আধুনিক ইউরোপের বিবর্তন – বাসবেন্দ বসু’; ‘উত্তোরনের পথে ইউরোপ – পুলকেশ রায়’ সহ প্রভৃতি নিবন্ধ ও গবেষণাকর্ম।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়