০২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব, প্রসার ও দর্শন

নওশীন নাওয়ার রাফা: সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ ঐশ্বরিক অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এসেছে, যার ভিত্তিতে পৃথিবীর আদ্যোপান্ত সর্বস্থানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শত-সহস্র ধর্ম। স্থান-কাল ও পাত্রভেদে নির্দিষ্ট আচরণ ও অনুশীলন, নৈতিকতা, বিশ্বাস, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, গ্রন্থ, পবিত্র স্থান, ভবিষ্যদ্বাণী, নীতিশাস্ত্র বা সংস্থার একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার নামই ধর্ম, যা মানবতাকে অতিপ্রাকৃত, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক উপাদানগুলোর সাথে সম্পর্কিত করে তোলে। হাজারো ধর্মের ভীড়ে স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরী করতে পারা ধর্মের সংখ্যা ইহলৌকিক অবস্থানে গুটিকয়েক। যদিও সকল ধর্মের মূল বাণী বা চেতনা শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া, তথাপি ধর্মীয় চৈতন্যে সনাতন (হিন্দু), খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং ইসলাম -এই চারটি ধর্মই মূলত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। তন্মধ্যে, খ্রিস্টধর্মের প্রেক্ষাপট, আবির্ভাব, প্রসার ও দর্শন নিয়েই এই গোটা লেখনীটি তৈরী করা হয়েছে।

খ্রিস্টধর্ম অব্রাহামীয় একেশ্বরবাদী এক ধর্ম, যা মধ্যপ্রাচ্যের (বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের উত্তরভাগে অবস্থিত) ঐতিহাসিক গালীল অঞ্চলের নাসরৎ শহর থেকে আগত ইহুদি বংশোদ্ভূত ধর্মীয় নেতা যিশুখ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয়। এই ধর্মের অনুসারীরা খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত। তারা একটি ধর্মীয় পুস্তকসমগ্র অনুসরণ করে, যার সামগ্রিক নাম বাইবেল। বাইবেলের পুস্তকগুলিকে দুইটি বড় অংশে ভাগ করা হয়েছে: পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়ম। খ্রিস্টানরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এবং আরও বিশ্বাস করে যে যিশু হলেন খ্রিস্ট (অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্বাচিত), যাঁর মশীহ (মানবজাতির ত্রাণকর্তা) হিসেবে আগমনের ব্যাপারে ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল তথা পুরাতন নিয়মে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এবং নূতন নিয়মে তা বিবৃত হয়েছে। ২০১৫ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী বিশ্বে খ্রিস্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি, ফলে অনুসারীর সংখ্যা অনুযায়ী এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম।

খ্রিস্টধর্ম সাংস্কৃতিকভাবে এর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশীয় শাখাগুলির মধ্যে বিভক্ত এবং পরিত্রাণের প্রকৃতি ও প্রতিপাদন, যাজকাভিষেক, মণ্ডলীতত্ত্ব ও খ্রিস্টতত্ত্ব বিষয়ক মতাদর্শে বৈচিত্র্যময়। খ্রিস্টানদের সাধারণ ধর্মমত অনুসারে যিশু হলেন ঈশ্বরের পুত্র—মাংসে মূর্তিমান বাক্য—যিনি পরিচর্যা, দুঃখভোগ এবং ক্রুশারোহণ করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন, যা বাইবেলে সুসমাচার বলে অবিহিত হয়েছে। মথি, মার্ক, লূক ও যোহন – এই চার সাধুর রচিত চারটি সুসমাচারের পাশাপাশি এর পটভূমি হিসেবে ইহুদি পুরাতন নিয়ম হল যিশুর জীবন ও শিক্ষার বিবরণী।

খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিস্ট ইসরাঈলের জুদিয়া রাজ্যের বেথেলহেমে পবিত্র আত্মার মাধ্যমে অবিবাহিত অবস্থায় মেরী-র গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যসূত্রে জানা যায়, দম্পতি যোসেফ ও মেরী এর পুত্র সন্তানটিই যীশুখ্রিস্ট। ইহুদি পুরোহিতগণ যখন জানতে পারেন যীশুখ্রিস্ট ঈশ্বর প্রেরিত এবং ক্রমান্বয়ে তিনি যখন তার ধর্ম প্রচার করেন তখন তারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় গ্রহণ করেন। রোমান শাসকের সাহায্যে তারা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। যীশুর মৃতদেহ সমাধিতে রাখা হলে সেখান থেকে তা অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তিনি একাধিকবার তার শিষ্যদের সাথে দেখা করে স্বর্গে গমন করেন।

ইসলাম ধর্মে যিশুখ্রিস্টকে হযরত ঈসা (আ) নামে অভিহিত করা হয় এবং তার মায়ের নাম মরিয়াম (আ)। উভয়ে সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত নবী ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর অশেষ কুদরতে কুমারী মরিয়ামের ঘরে শিশু ঈসা-কে ভূমিষ্ঠ করান এবং পরবর্তীতে জীবদ্দশায় চতুর্থ আকাশে উঠিয়ে নেন। শেষ জমানায় আবারও পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটবে বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন।

যিশুখ্রিস্টের মুজিযা বা অলৌকিক কর্মকান্ডসমূহ নিয়েও রয়েছে বিস্তর বর্ণনা। তন্মধ্যে উল্লেখ্য কয়েকটি হচ্ছে, ১. অলৌকিকভাবে পিতা ছাড়া জন্মগ্রহণ; ২. জন্মের পর পরই নিজের এবং মায়ের সমর্থনে লোকদের সাথে কথা বলা; ৩. কাদামাটি দিয়ে তৈরি পাখির মধ্যে আল্লাহর নাম নিয়ে ফুঁ দিলে সেটি জীবিত হওয়া; ৪. আল্লাহর অনুগ্রহে হাতের ছোঁয়ায় জন্মান্ধ লোকদের দৃষ্টিশক্তি দান করা, কুষ্ঠ রোগের পূর্ণ নিরাময় দান; ৫. মানুষ ঘর থেকে যা খেয়ে আসে তা বলে দেওয়া ও অনুসারীদের জন্য জান্নাতী খাবার নিয়ে আসা এবং ৬. ইহুদি-পুরোহিত-রাজশক্তির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে তাঁকে জীবিত অবস্থায় আকাশে তুলে নেওয়া।

খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর মধ্যভাগে লেভ্যান্টে (পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল) খ্রিস্টধর্মের উত্থান ঘটে। জেরুজালেম থেকে সমগ্র নিকট প্রাচ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রসারলাভ করেছিল সেসময়। আরাম, আসিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, ফিনিশিয়া, এশিয়া মাইনর, জর্ডান ও মিশর ছিল খ্রিস্টধর্মের প্রথম যুগের প্রধান কেন্দ্রসমূহ। ৭০ খ্রিস্টাব্দে যিরূশালেমের (জেরুজালেম) পতনের পর দ্বিতীয় মন্দিরভিত্তিক ইহুদিধর্মের অবসান ঘটে এবং খ্রিস্টধর্ম ক্রমশ ইহুদিধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সম্রাট মহান কনস্টান্টিন মিলান ফরমান (৩১৩ খ্রি.) জারি করার মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মকে বৈধতা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নিকেয়ার প্রথম পরিষদ (৩২৫ খ্রি.) আহ্বান করেন, যেখানে প্রারম্ভিক খ্রিস্টধর্মকে সংহত করা হয়, যা রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় আচারে (৩৮০ খ্রি.) পরিণত হয়।

খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টধর্ম রাজধর্মের স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। ৩০১ সালে আর্মেনিয়ায়, ৩১৯ সালে জর্জিয়ায়, ৩২৫ সালে আকসুমাইট সাম্রাজ্যে এবং ৩৮০ সালে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম রাজধর্মের স্বীকৃতি পায়। ৪৫১ সালে কাউন্সিল অফ ক্যালসেডন খ্রিস্টধর্মকে ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্সি ও ক্যালসিডোনীয় খ্রিস্টধর্ম – এই দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে দেয়। ১০৫৪ সালে মহাবিভাজনের সময় ক্যালসিডনীয় খ্রিস্টধর্ম রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চে বিভক্ত হয়ে যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রোটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নতুন খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। পরে এই সম্প্রদায় থেকে অনেকগুলি পৃথক খ্রিস্টীয় সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়।

মধ্যযুগে রোমান ক্যাথলিক ও ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম সমগ্র ইউরোপে প্রসারিত হয়েছিল। নবজাগরণের সময় থেকে শুরু করে ইউরোপের আবিষ্কার যুগে খ্রিস্টধর্ম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হয়। এর ফলে এই ধর্ম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা দুইশ কোটি, যা বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি।

আবিষ্কারের যুগের (১৫শ–১৭শ শতাব্দী) পর উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিভিন্ন প্রচারাভিযানের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম দুই আমেরিকা মহাদেশ, এশিয়া, ওশেনিয়া, সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সূত্রমতে, খ্রিস্টধর্মের চারটি বৃহত্তম শাখা হল ক্যাথলিক মণ্ডলী (১৩০ কোটি/৫০.১%), প্রতিবাদী মণ্ডলী (৯২ কোটি/৩৬.৭%), পূর্বদেশীয় সনাতনপন্থী মণ্ডলী (২৩ কোটি) ও প্রাচ্যদেশীয় সনাতনপন্থী মণ্ডলী (৬ কোটি ২০ লক্ষ/১১.৯%), যাদের মধ্যে ঐক্যের (বিশ্বব্যাপ্তিবাদ) বিভিন্ন প্রচেষ্টা জারি রয়েছে।

পাশ্চাত্যে খ্রিস্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা সাম্প্রতিককালে হ্রাস পেলেও এটি এখনও অঞ্চলটির (তথা পৃথিবীর) সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্ম, যেখানে প্রায় ৭০% জনগণ নিজেদের খ্রিস্টান হিসেবে চিহ্নিত করে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মহাদেশ আফ্রিকা ও এশিয়ায় খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিপীড়নের শিকার।

ভিন্ন একটি সূত্রের লেখনী মতে, খ্রিস্টধর্ম প্রথমে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলিতে ইহুদিধর্মের একটি উপ-সম্প্রদায় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। খ্রিস্টের মৃত্যুর পরে তার আদি বারো শিষ্য জেরুসালেম থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়েন। কয়েক দশকের মধ্যে খ্রিস্টে বিশ্বাসী অনুসারীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বারো শিষ্যের বাইরে খ্রিস্টধর্মের বাণীর আদি প্রচারকদের মধ্যে সন্ত পৌল (৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ- আনু. ৬৭ খ্রিস্টাব্দ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; বাইবেলের নতুন নিয়মের ২৭টি পুস্তকের মধ্যে ১৩টিই তিনি রচনা করেন।

খ্রিস্টীয় ১ম শতকেই বারো শিষ্যদের সবার মৃত্যু হয়। এরপর ২য় ও ৩য় শতকে খ্রিস্টের বারো শিষ্যের উত্তরসূরী ধর্মবিদেরা খ্রিস্ট ধর্মের তত্ত্ব নির্মাণ ও প্রচার অব্যাহত রাখেন; তাদের রচনার অংশবিশেষ নতুন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসময় খ্রিস্টধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ অ-ইহুদি ধর্ম হিসেবে রোমান সাম্রাজ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। একই সাথে ধর্মটি মধ্যপ্রাচ্য, ইথিওপিয়া (আকসুম সাম্রাজ্য) ও আন্তঃককেশিয়ার বিশাল অংশে এবং এশিয়ার কিয়দংশে ছড়িয়ে পড়ে।

আকসুম সাম্রাজ্য প্রথম সাম্রাজ্য হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। ৪র্থ শতকে রোমান সম্রাট কোনস্তানতিন খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং তিনি ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে মিলানের রাজকীয় অধ্যাদেশবলে খ্রিস্টধর্মকে আইনবিরুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা বন্ধ করেন। এর প্রেক্ষিতে এটি সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মে পরিণত হয়।

৩২৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কোনস্তানতিনের আহুত নিকায়েয়া-র (বর্তমান তুরস্কের ইজনিক শহর) ধর্মীয় সম্মেলনে খ্রিস্টধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাসের সারসংক্ষেপ প্রথমবারের মত রচিত হয়। এতে বাইবেলে বর্ণিত পিতারূপী ঈশ্বর, পুত্ররূপী ঈশ্বর (যিশু) ও পবিত্র আত্মারূপী ঈশ্বর – এই তিন সত্তাই যে একই ঈশ্বরের তিন রূপ, এই ত্রিত্ববাদ ধারণাটি গৃহীত হয়।

বর্তমানে খ্রিস্টান মণ্ডলীগুলির সিংহভাগ ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী; তবে মূলধারার বাইরে অনেক ছোট ছোট মণ্ডলী এতে বিশ্বাস করে না। ৫ম শতকে খ্রিস্টধর্মের নেতৃস্থানীয় ধর্মযাজকেরা ধর্মগ্রন্থসমগ্র বাইবেলের সংকলন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। মধ্যযুগে এসে ইউরোপের বাকি অংশগুলিরও খ্রিস্টধর্মায়ন ঘটে। সে সময় খ্রিস্টানরা মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের অংশবিশেষেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে বাস করত।

আবিষ্কারের যুগের পরে উপনিবেশ স্থাপন ও জোরালো ধর্মপ্রচারণার সুবাদে খ্রিস্টধর্ম সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্বের অন্যত্র (যেমন পূর্ব এশিয়া বিশেষত ফিলিপাইন) ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী বিরাজমান প্রধান ধর্ম।

২০১১ সালে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিউ গবেষণাকেন্দ্রের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী খ্রিস্টানরা বিশ্বের সর্বব্যাপী এত বেশি ছড়িয়ে আছে যে কোনও একক একটি মহাদেশ বা অঞ্চল বিশ্ব খ্রিস্টান মণ্ডলীর কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে দাবী করতে পারে না। এটি একটি সাম্প্রতিক ঘটনা।

২০শ শতকের শুরুতে এসেও ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ খ্রিস্টান ইউরোপ মহাদেশে বাস করত এবং এ অবস্থাটি তার আগের এক সহস্রাব্দ থেকেই বিরাজ করছিল। ২১শ শতকের শুরুতে এসে বিশ্বের খ্রিস্টানদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ইউরোপে বাস করে, এবং এর বিপরীতে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি দুই আমেরিকা মহাদেশে বাস করে। এছাড়া প্রায় এক-চতুর্থাংশ খ্রিস্টান সাহারা-নিম্ন আফ্রিকাতে এবং প্রায় এক-অষ্টমাংশ এশিয়া মহাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাস করে।

ধর্ম মানব জীবনের একটি অপরিহার্য বিষয়। এটা মানুষকে জাগতিক, নৈতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নে সহায়তা করে। যে জীবনে মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ থাকে না বা তার অভাব ঘটে, সে জীবন কখনও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে না। সে মানুষের জীবনে দেখা দেয় অনেক প্রকার বিপর্যয় এবং তারা অন্যের জীবনে ও সমাজে সৃষ্টি করে নানাবিধ অনর্থ এবং অনাচার। ধর্মকে ধারণ এবং অনুশীলন করেই মানুষ তার মানবিক গুণাবলীর স্ফুরণ ঘটাতে সক্ষম হয়, জীবনে জাগে ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শ্রদ্ধাশীলতা, বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও শৃংখলাবোধ। ধর্মীয় তত্ত্ব ও তথ্য জ্ঞান মানুষকে দেয় আধ্যাত্মিক জীবনে পথনির্দেশ। খ্রিস্টধর্ম যীশু খ্রিস্টের শিক্ষা, আদেশ, নির্দেশ ও জীবনাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। একেশ্বরবাদ এই ধর্মের ভিত্তি এবং পবিত্র বাইবেল ইহার মূল উৎস।

তাই সকলকেই খ্রিস্টধর্মের মূল শিক্ষা ও চেতনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা ও গড়ে তোলা আমাদের কর্তব্য। তাতে আমরা মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হয়ে যেমন নিজেদের জীবনে সুখ শান্তি লাভ করতে পারবো, তেমনি অন্যের এবং সামাজিক জীবনেও বিভিন্ন সেবাম লক ও মঙ্গলজনক কাজকর্ম করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে সক্ষম হবো। তাতে আমাদের সকলের মানবিক জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।

খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা হল একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও একটি জীবনঘনিষ্ঠ দর্শন -এর সমাহার। পরিবর্তিত পরিবেশ ও মন মানসিকতার উপর নির্ভর করেই এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে সাজাতে হবে, যেন আমরা জীবনের লক্ষ্যে আকাংক্ষিত ফল লাভ করতে পারি। খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাস তদানীন্তন অন্য সকল ধর্ম হতে আলাদা এবং যুগান্তকারী দর্শন চিন্তার অধিকারী ছিলো। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,

একেশ্বরবাদ: খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনি সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। তার কোনো অংশীদার নেই; প্রেমময় ঈশ্বরবাদী: খ্রিস্টানদের মতে, ঈশ্বর হচ্ছেন Loving father বা প্রেমময় পিতা কিংবা Kind of God বা পরম দয়ালু প্রভু। আর মানুষ হচ্ছে Loving Child বা ভালোবাসার সন্তান; মোক্ষবাদী: খ্রিস্টানরা মনে করেন, যীশু ইচ্ছে করলে পাপীকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনি চিরকালের জন্যে সব পাপীকে ভালোবাসার পথ অনুসরণ করে মোক্ষ লাভের জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন; অমরত্ববাদী: খ্রিস্টধর্মে জীবাত্মার অমরত্বে বিশ্বাস পোষণ করা হয়। আত্মার মৃত্যু নেই। স্থানান্তর বা দেহান্তর রয়েছে; স্বর্গীয় দূতে বিশ্বাসী: খ্রিস্টধর্মে স্বর্গীয় দূত বা ফেরেশতায় বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। তাঁরা নারী বা পুরুষ নন। তাদের নিদ্রা, খাওয়া বা বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। তাঁরা শুধু সৃষ্টিকর্তার অনুগত্য করে; শেষ বিচারে বিশ্বাসী: শেষ বিচারের দিন মানুষকে আবার তাদের নিজ নিজ কর্মের হিসাব দেয়ার জন্য ডাকা হবে। মানুষ তার স্ব-স্ব কর্মফল হিসাবে সেদিন পুরস্কার বা শাস্তি গ্রহণ করবেন; শয়তান বা অশুভ শক্তিতে বিশ্বাসী: শুভ শক্তির পাশাপাশি পৃথিবীতে যে Evil বা অশুভ শক্তিও রয়েছে খ্রিস্টধর্ম এ বিশ্বাসও পোষণ করে। কারণ পৃথিবীতে যত অকল্যাণ ও পাপ কাজ সাধিত হয় তার সবই হয় অশুভ শক্তির কুপ্রভাবে; ত্রিত্ববাদী: খ্রিস্ট ধর্মমতে ঈশ্বরের তিন রূপ। এগুলো হলো, ক. God the Father বা পিতা ঈশ্বর, খ. God the Son বা পুত্র ঈশ্বর এবং গ. God the Holy spirit বা পবিত্র আত্মা ঈশ্বর। তবে ঈশ্বরের তিনটি দিক মাত্র, ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর নয়। বরং এই তিনের সমন্বয়ই সর্বশক্তিমান এক ও অবিনশ্বর ঈশ্বর; প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম: খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী। মানুষ নিজ থেকে ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম নয় যতক্ষন না ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জ্ঞান না দেন; অন্যান্য বৈশিষ্ট্য: খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরের পিতৃত্বে পূর্ণ বিশ্বাসী। যীশুখ্রিস্টের ত্রাণতত্ত্বে, মধ্যস্থতায় এবং তার অনুসরণে বিশ্বাসী। খ্রিস্টানরা কৃচ্ছতাবাদবিরোধী। ক্রুশ হচ্ছে তাদের ভালোবাসার চিহ্ণ। যে কেউ এই ধর্ম গ্রহণ করতে পারে বলে এটি একটি সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন ধর্ম হিসাবে স্বীকৃত।

খ্রিস্টানেরা বিশ্বাস করে একজন মাত্র ঈশ্বর স্বর্গ ও মর্ত্যের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। অর্থাৎ ঈশ্বর জগতের পিতা। পিতারূপী ঈশ্বর প্রতিটি মানুষকে সন্তানের মতো ভালোবাসেন এবং তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চান। কিন্তু প্রতিটি মানুষ পাপ করার প্রবণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে (যার উৎস প্রথম মানব আদমের আদিপাপ)। এই সব ছোট-বড় পাপের কারণে মানুষ ও জগতের পিতা ঈশ্বরের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।

খ্রিস্টানেরা বিশ্বাস করে যে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরেরই দ্বিতীয় একটি রূপ; তিনি ঈশ্বরের একমাত্র প্রকৃত পুত্র। ঈশ্বরের তৃতীয় আরেকটি রূপ হল পবিত্র আত্মা। পবিত্র আত্মা বিভিন্ন নবী বা ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে মানবজাতির সাথে যোগাযোগ করেছে। পবিত্র আত্মারূপী ঈশ্বর মানব কুমারী মেরির গর্ভে পুত্ররূপী ঈশ্বর তথা যিশুখ্রিস্টের জন্ম দেন, যার সুবাদে যিশুখ্রিস্ট রক্তমাংসের মানুষের রূপ ধারণ করে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন। পবিত্র আত্মারূপী ঈশ্বরের সুবাদে পুত্ররূপী ঈশ্বর যিশুখ্রিস্ট পৃথিবীতে বহু অলৌকিক কাজ সম্পাদন করেন। শেষ পর্যন্ত যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণাভোগ করে মৃত্যুবরণ করে সমগ্র মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন।

কিন্তু তিন দিন পরে তিনি মৃত্যুকে পরাজিত করে পুনরুজ্জীবিত হন এবং স্বর্গে আরোহণ করেন যেখানে তিনি পিতারূপী ঈশ্বরের ডান পাশের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ঈশ্বর উপহার হিসেবে সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। সময়ের যখন সমাপ্তি হবে, তখন যিশু আবার পৃথিবীতে ফেরত আসবেন এবং শেষ বিচারে সমস্ত মানবজাতির (মৃত বা জীবিত) বিচার করবেন। যারা যিশুখ্রিস্টে বিশ্বাস আনবে এবং ঈশ্বরের ক্ষমা গ্রহণ করবে, তারাই ভবিষ্যতে শেষ বিচারের দিনে পরিত্রাণ পাবে ও স্বর্গে চিরজীবন লাভ করবে। পুরাতন নিয়মের পুস্তকগুলিতে যে মসিহ বা ত্রাণকর্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যিশুই সেই ত্রাণকর্তা। তারা যিশুকে একজন নৈতিক শিক্ষক, অনুকরণীয় আদর্শ এবং প্রকৃত ঈশ্বরকে উদ্ঘাটনকারী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করে।

এসব আলোচনায় ভুলে গেলে চলবেনা বাংলায় তথা ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের প্রসার বিশ্ব মানচিত্রের ইতিহাসে অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। পরবর্তীতে ঔপনিবেশিকতাবাদ হতে শুরু করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্ভব সবকিছুর মূল ভিত্তি ছিলো খ্রিস্টধর্মের প্রসার।

বাংলার চার প্রধান ধর্মের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের আগমনই সবার শেষে। মোটামুটি ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় ৫০০ বছর পর বাংলায় খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। বাংলায় আগত প্রথম খ্রিস্টান ছিলেন সম্ভবত নেস্টরীয় খ্রিস্টানরা, তবে তারা ছিলেন পেশায় সওদাগর। এ দেশে ধর্ম প্রচারের অভিসন্ধি তাদের ছিল না বললেই চলে। তেমনি বাংলায় আসা আর্মেনীয় বণিকেরাও বেশি ধর্ম বিস্তারে মন দেয়নি।

বাংলায় খ্রিস্টধর্ম প্রথম প্রচারিত হয় সম্ভবত ষোলো শতকে পর্তুগিজদের মাধ্যমে। পরবর্তী দুশ বছর প্রধানত দুটি রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায় জেশিট ও অগাস্টিনিয়ানদের মাধ্যমে এর প্রচার কাজ চলে। পর্তুগিজরা সম্রাট আকবরের নিকট থেকে হুগলিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি পেলে জেশিটরা ১৫৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সেখানে একটি স্কুল ও একটি হাসপাতাল স্থাপন করে। আঠারো শতকের শেষদিকে পোপ কর্তৃক তাদের প্রচার বন্ধের পূর্ব পর্যন্ত তারা বাংলায় ধর্ম প্রচার করে।

বাংলায় খ্রিস্টধর্মীয় কর্মকান্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করে অগাস্টিনিয়ানরা। তারা ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে একটি গির্জা স্থাপন করে, সেখান থেকে ঢাকাসহ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা হয়। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হুগলিতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০০, যাদের মধ্যে ছিল পর্তুগিজ, তাদের ইউরেশিয়ান বংশধর এবং ক্রীতদাসসহ অন্যান্য ধর্মান্তরিতরা। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান হুগলি আক্রমণ করলে গির্জাটি ধ্বংস হয়; তবে পরবর্তীকালে অগাস্টিনিয়ানরা ব্যান্ডেলে বসতি স্থাপনের অনুমতি পায় এবং সেখানে একটি গির্জা নির্মাণ করে, যা এখনও বর্তমান।

পর্তুগিজরা আরাকানরাজের সহায়তায় ষোলো শতকেই চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। অগাস্টিনিয়ানরা সেখানে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং কয়েক হাজার লোককে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেয়, যাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে দস্যুতাকালে ধরা হয়েছিল। পরে সতেরো শতকে নগরী তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর আগে ভূষণার (যশোর) রাজপুত্র খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে অ্যান্টোনিও ডি রোজারিও নাম গ্রহণ করেন এবং প্রধানত নিম্নবর্ণের ২০,০০০ হিন্দুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। সতেরো শতকের নববইয়ের দশকে বাংলায় ১৩টি অগাস্টিনিয়ান গির্জা ছিল।

দীক্ষিত খ্রিস্টানদের অধিকাংশকেই প্রাথমিক কিছু নিয়ম-কানুন ও উপদেশ দেওয়া হতো এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ নতুন কেন্দ্রগুলিতে অভিবাসী হতে চাইত; এমন একটি কেন্দ্র ছিল কলকাতা, যেখানে ইংরেজরা ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে বসতি স্থাপন করে। অগাস্টিনিয়ানরা সেখানে একটি ক্ষুদ্র উপাসনালয় স্থাপন করেছিল। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা খ্রিস্টানদের সেবার জন্য চন্দননগরে একজন জেশিউটকে নিয়োগ করে। আর্মেনিয়ানরা ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় একটি গির্জা স্থাপন করে এবং তার পরপর কলকাতা ও ঢাকায়ও দুটি গির্জা স্থাপিত হয়।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার প্রতিনিধি ও কর্মচারীদের জন্য যাজক নিযুক্ত করে এবং ১৮১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ব্রিটিশ সরকার অনুমোদিত গির্জায় বিশপের পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে জনগণের বিরোধিতার ভয়ে কোম্পানি প্রচার কাজ বন্ধ রাখে; পরে অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে তা চালু করা হয়। তবে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির উইলিয়ম কেরী এ দেশে আসার পর ১৭৯৩ থেকেই প্রটেস্টানদের কর্মকান্ড চলতে থাকে।

১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম কেরী শ্রীরামপুরের ডেনিশ বসতিতে জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ডর যোগদান করেন। শ্রীরামপুরের এ পাদ্রী ত্রয়ী খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যার পাঠ্যসূচিতে আধুনিক বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁরা এসব স্কুলের জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রেস থেকে সেসব প্রকাশ করেন।

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় তাঁরা উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করেন। এ সোসাইটি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ব্যবহারের জন্য উপর্যুক্ত গ্রন্থসমূহের হাজার হাজার কপি মুদ্রণ করে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীরামপুর কলেজ, যেখানে খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান ছাত্ররা কলা, বিজ্ঞান ও ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেড্রিক ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের এক সনদে এ কলেজটি অনুমোদন করেন। এটি তখন একটি অসাধারণ তথ্যভান্ডারে পরিণত হয়। কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিকে এর অবস্থার অবনতি ঘটে এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট হলওয়েল কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত হলে এটি ভারতে ধর্মশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।

পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্টরা বাংলা ভাষার উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিদেশিদের বাংলা শেখা ও দেশিদের খ্রিস্ট সাহিত্য পড়ার সুবিধার্থে তাঁরা একটি অভিধান ও একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং বাইবেলেরও অনুবাদ করেন। তাঁরা দিগ্দর্শন ও সমাচার দর্পণ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সংবাদপত্রের সূচনা করেন; দি স্টেটসম্যান পত্রিকার পূর্বপুরুষ দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া প্রকাশও তাঁদের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

কেরী শ্রীরামপুরে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সেখানে বাগান তৈরি করেন এবং বিদেশ থেকে বীজ এনে নতুন জলবায়ু গ্রহণে সক্ষম বৃক্ষ উৎপাদন করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া স্থাপনেও নেতৃত্ব দেন। শ্রীরামপুরের যাজকরা সমকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত অমানবিক আচরণ, যেমন সাগরদ্বীপে শিশুহত্যা, সতীদাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও সরকারকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন; এসবের ওপর তাঁরা একটি গবেষণাও চালিয়েছিলেন।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পরে বাংলায় ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির অনুসরণে যে প্রটেস্টান্ট মিশনারি সোসাইটিগুলি কাজ করে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: লন্ডন মিশনারি সোসাইটি, চার্চ মিশনারি সোসাইটি এবং চার্চ অব স্কটল্যান্ড। চার্চ মিশনারি সোসাইটি ছিল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এটি ভারতে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালনকারী মেরী অ্যান কুককে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রাথমিক সমর্থন জানিয়ে আসছিল।

এরপর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ পাদ্রী আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতা আসেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য নতুন পর্যায়ের কাজ শুরু করেন। তিনি একটি স্কুল স্থাপন করেন যা দ্রুত ও দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত স্কটিশচার্চ কলেজ নামে সুপরিচিত হয়। ডাফ আবৃত্তিমূলক শিক্ষা অনুমোদন করেন এবং ছাত্রদের মধ্যে আগ্রহ ও বোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরু দায়িত্বের ওপর জোর দেন। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানব তৈরি এবং শরীরচর্চা ও খেলাধুলার সুযোগ তৈরির প্রতিও উৎসাহী ছিলেন। ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও অনমনীয়। অন্যান্য মিশনারিরাও এ কাজ শুরু করেছিলেন এবং তাঁর এ উদ্যোগের কারণেই সরকার ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলায় খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ও অবদানও অনস্বীকার্য। আধুনিক বাংলার উন্নয়নে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের ভাষাভিত্তিক ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ড এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে তাঁরা প্রধানত ধর্মযাজকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসব করতেন। তাঁরা মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে, তাদের মুক্তি একমাত্র খ্রিস্টধর্মেই নিহিত, যদিও এ ক্ষেত্রে তাঁদের সফলতা ছিল খুবই কম।

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যাপ্টিস্টরা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা বাংলায় মিশন স্থাপন করা সত্ত্বেও তিন হাজারের বেশি লোককে ধর্মান্তরিত করতে পারেননি; তাও তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ছিল অন্য খ্রিস্টান চার্চের লোক। ধর্মান্তর প্রক্রিয়া পরিবার ও সমাজ থেকে বহিষ্কার এবং গ্রাম এলাকায় জমিদারদের বিরোধিতার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়।

আলেকজান্ডার ডাফ এ ব্যাপারে কলকাতার বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, যাঁরা ইতোমধ্যেই পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন; কেউ কেউ আবার ইতোমধ্যে ধর্মান্তরিতও হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কয়েকজন, বিশেষত কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন।

তখন গণধর্মান্তর ছিল একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার; তবে এরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল উনিশ শতকের তিরিশের দশকের শেষদিকে কৃষ্ণনগর অঞ্চলে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে। এ সম্প্রদায়ের অনেক মতবাদ খ্রিস্টধর্মেরই অনুরূপ; উপরন্তু এ সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল অর্থনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যায় আক্রান্ত; সুতরাং তারা সহজেই পাদ্রীদের প্রচারিত খ্রিস্টধর্মে আকৃষ্ট হয়।

ব্যাপ্টিস্টরা বরিশাল এলাকায় বেশ সাফল্য অর্জন করে। সেখানে প্রধানত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৭৮-এ। কিন্তু এ খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল দরিদ্র এবং দীর্ঘকাল মিশনারি সোসাইটির সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

উনিশ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়েই হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের প্রতি পাদ্রিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমালোচনামূলক ও বিরোধমূলক, যা স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা বিরুদ্ধ মতবাদের সৃষ্টি হয়। পাদ্রীদের এ কর্মকান্ড হিন্দুধর্মের সংস্কার আন্দোলনকে উৎসাহিত করে, যার ফলে ব্রাহ্মসমাজ, তত্ত্ববোধিনী সভা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। পাদ্রীরা তখন মুসলমানদের সঙ্গে অধিক ধর্মীয় সাদৃশ্য দেখতে পান, যদিও ধর্মান্তরীকরণে তাদের নিকট থেকে বাধাও পেয়েছেন অনুরূপ।

তবে পাদ্রীরা পল্লীর দরিদ্র জনগণের দুরবস্থা দেখে যথার্থই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই চার্চ মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড জেমস লং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করানোর ব্যবস্থা করেন। এতে নীলচাষের অত্যাচার উৎপীড়ন চিত্রিত হয়েছে এবং এ কারণে নীলকরদের দ্বারা অভিযুক্ত হয়ে তিনি কিছুকাল কারাবাস করেছিলেন।

ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার কারণে লং ছিলেন উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতীয় ব্রিটিশদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তবে এ শতকের শেষদিকে পাদ্রীরা হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের প্রতি অধিকতর সহানুভূতি দেখাতে শুরু করেন। জে.এন ফারকুহরের দৃষ্টান্তে একথা প্রমাণিত হয়। তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার YMCA-এর সেক্রেটারি হয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের প্রতি ফারকুহরের এ উৎসাহ ইসলাম ধর্মের প্রতি ব্যাপ্টিস্ট বেভান জোনসকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় কাজ করেছেন।

১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক চার্চ শক্ত ভিতের ওপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় পর্তুগিজ শাসনের বাইরে পোপ কর্তৃক তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে একজন যাজক নিযুক্ত হন। বেলজিয়াম যাজকরা এ ধরনের কাজ শুরু করেন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। তাঁরা কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আর্চবিশপের অধীনে কলকাতায় একটি ধর্মীয় প্রশাসনিক এলাকা তৈরি হয়; সেসঙ্গে পূর্ববঙ্গে হলিক্রস ফাদারসহ কতিপয় নতুন নিয়ম-কানুনও প্রবর্তিত হয়।

পাদ্রীরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রাবাসসহ শিক্ষাখাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। বাংলায় ইংল্যান্ড সরকার অনুমোদিত মৈত্রী সঙ্ঘ অক্সফোর্ড মিশনও ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার দক্ষিণে বেহালায় একটি কারিগরি বিদ্যালয় গড়ে তোলে। কিছু কিছু চিকিৎসা কর্মকান্ডও হাতে নেওয়া হয়। ১৯০৮ সালে চন্দ্রঘোনায় একটি ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি হাসপাতাল খোলা হয়। এরপরে একটি কুষ্ঠ নিরাময় কেন্দ্র এবং সবশেষে বল্লভপুরে একটি চার্চ মিশনারি সোসাইটি হাসপাতালও স্থাপন করা হয়।

কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতে ভারতীয়দের দ্বারাই খ্রিস্টধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচার করা সম্ভব; তবে এর কর্তৃত্ব থাকবে বিদেশি মিশনারিগুলির হাতেই। এ কারণে শতবর্ষ পরেও খ্রিস্টধর্মকে বিদেশাগত বলেই মনে হয়েছে এবং বর্তমানে জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ব্যাপকভাবে ভারতীয়করণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগের পর ঢাকা রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ এবং অ্যাংগলিকান বিশপের কর্মকান্ডের কেন্দ্র হয়। পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তর ভারত এবং পাকিস্তানে অ্যাংগলিকান ও আরও অনেক প্রটেস্টান গোষ্ঠীর মধ্যে মিলনের এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। উভয় দেশে এটা ঘটেছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে।

এরপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন অ্যাংগলিকান ও যাজক সম্প্রদায়ের সম্মিলনে চার্চ অব বাংলাদেশ গঠিত হয়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে এর দুজন বিশপ এবং প্রায় ১৪,০০০ জন সদস্য ছিল। এর মধ্যে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট সংঘ) কর্তৃক সৃষ্ট উপাসকমন্ডলীও রয়েছে। বাংলাদেশে বৃহত্তম খ্রিস্টান সম্প্রদায় হচ্ছে রোমান ক্যাথলিক, যাদের সংখ্যা বাংলাদেশে মোট পাঁচ লক্ষ খ্রিস্টান জনসংখ্যার মধ্যে দু লাখেরও বেশি।

এসবের পাশাপাশি আমাদের পালিত ইসলাম ধর্মেও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম বিশ্বের দুটি বৃহত্তম ধর্ম, যার উভয়টিতে দুই বিলিয়নের বেশি অনুসারী রয়েছে। উভয় ধর্মই ইব্রাহিমীয় ধর্ম এবং একেশ্বরবাদী হিসাবে বিবেচিত হয়, যা মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত। খ্রিস্টধর্ম খ্রিস্টীয় ১লা শতাব্দীতে দ্বিতীয় মন্দির ইহুদি ধর্ম থেকে বিকশিত হয়েছিল। এটা যীশু খ্রীষ্টের জীবন, শিক্ষা, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যারা এটি অনুসরণ করে তাদের খ্রিষ্টান বলা হয়। ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের বিকাশ ঘটে। ইসলামের প্রতিষ্ঠা মুহাম্মদের শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের প্রকাশ। যারা এর অনুসরণ করে তাদের মুসলমান বলা হয় যার অর্থ “ঈশ্বরের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা।”

ইসলাম যীশুকে আল-মশীহ বলে মনে করে, যাকে বনি ইসরাইল (ইস্রায়েলের সন্তান) একটি নতুন আপ্তবাক্য দিয়ে পথ দেখানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল আল-ইনযিল। খ্রিস্টধর্ম ও বিশ্বাস করে যে যীশু হিব্রুয় শাস্ত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করা মশীহা। কিন্তু, খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের অনেক বেশি কেন্দ্রবিন্দু হল যীশু হলেন অবতারিত ঈশ্বর, বিশেষত, ত্রিত্ব ঈশ্বরের অন্যতম হিপস্পদ, ঈশ্বর পুত্র। যীশুর প্রতি বিশ্বাস খ্রিষ্টান এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব উভয়েরই একটি মৌলিক অংশ।

খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের বিভিন্ন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। খ্রিস্টধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল এবং ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে আল-ইঞ্জিলকে বিকৃত করা হয়েছিল বা খ্রিষ্টান নতুন নিয়ম গঠনের জন্য পরিবর্তন করা হয়েছিল। এর বিপরীতে, খ্রিষ্টানদের কুরআন সম্পর্কে একক ধারণা নেই, যদিও বেশিরভাগই বিশ্বাস করে যে এটি বানোয়াট বা ধর্মত্যাগী কাজ। উভয় গ্রন্থে যিশুর জীবন ও কর্মের বিবরণ এবং মরিয়মের মাধ্যমে যিশুর কুমারী জন্মের মতো মিল রয়েছে; তবুও, এই ঘটনাগুলির কিছু বাইবেল এবং কুরআনীয় বিবরণ ভিন্ন।

হজরত মরিয়ম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘আর বর্ণনা কর এই কিতাবে উল্লিখিত মরিয়মের কথা, যখন সে তার পবিরবর্গ হতে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল, অতঃপর উহাদিগ হতে সে পর্দা করল। অতঃপর আমি তার নিকট আমার রুহকে পাঠালাম, সে তার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল।’

মরিয়ম বলল, “আল্লাহকে ভয় করো যদি তুমি মুত্তাকী হও, আমি তোমা হতে দয়াময়ের শরণ নিচ্ছি।” সে বলল, “আমি তো তোমার প্রতিপালক প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য।” মরিয়ম বলল, “কেমন করে আমার পুত্র হবে? যখন আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই।” সে বলল, “এই রূপেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন—ইহা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি উহাকে এই জন্য সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট হতে এক অনুগ্রহ; ইহা তো এক স্থিরকৃত ব্যাপার।”

অতঃপর সে গর্ভে উহাকে ধারণ করল; অতঃপর তৎসহ এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল; প্রসববেদনা তাকে এক খর্জুর-বৃক্ষ তলে আশ্রয় লইতে বাধ্য করল। সে বলল, হায়! ইহার পূর্বে আমি যদি মরে যেতাম ও লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম। ফেরেশতা তার নিম্ন পার্শ্ব হতে আহ্বান করে তাকে বলল, “তুমি দুঃখ করো না, তোমার পাদদেশে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খর্জুর-বৃক্ষকে নাড়া দাও, উহা তোমাকে সুপরিপক্ক তাজা খর্জুর দান করবে। সুতরাং আহার করো, পান করো ও চক্ষু জুড়াও।”

মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখো তখন বলো, “আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতা অবলম্বনের রোজার মান্নত করেছি সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সহিত বাক্যালাপ করব না।” অতঃপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলে; উহারা বলল, “হে মরিয়ম! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে আছো। ‘হে হারুন-ভগ্নি! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ছিলেন না ব্যভিচারিণী।”

অতঃপর মরিয়ম সন্তানের প্রতি ইঙ্গিত করল। উহারা বলল, “যে কোলের শিশু তার সহিত আমরা কেমন করে কথা বলব?” সে (শিশু ঈসা নবী আ.) বলল, “আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়াছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মাতার প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও হতভাগ্য; আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।” এই-ই হলো মরিয়ম তনয় ঈসা (আ.)। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে উহারা বিতর্ক করে।’ (সূরা: ১৯ মরিয়ম, আয়াত: ১৬-৪০)।

কোরআন কারিমে হজরত ঈসা (আ.)–এর নাম বিভিন্ন প্রসঙ্গে ২৫ বার উল্লেখ হয়েছে। হজরত মরিয়ম (আ.)–এর নামে কোরআনুল কারিমে একটি স্বতন্ত্র সুরাও রয়েছে এবং মরিয়ম শব্দটি কোরআন কারিমে নানানভাবে ৩৫ বার উল্লিখিত হয়েছে। হজরত ঈসা (আ.)–এর সৃষ্টি হজরত আদম (আ.)–এর মতো। ‘আল্লাহর নিকট নিশ্চয় ঈসা (আ.)–এর দৃষ্টান্ত আদম (আ.)–এর দৃষ্টান্তসদৃশ। তিনি তাকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছিলেন; অতঃপর তাকে বলেছিলেন “হও”, ফলে সে হয়ে গেল।’ (সুরা-৩, আল ইমরান, আয়াত: ৫৯)।

হজরত ঈসা (আ.)–এর জন্ম যেমন বিস্ময়কর, তাঁর পুনরাবির্ভাবও হবে বিস্ময়করভাবে। তাঁর সম্পর্কে কোরআন মাজিদে আছে, ‘আর “আমরা আল্লাহর রাসুল মারইয়াম তনয় ঈসা মাসিহকে হত্যা করেছি”—তাদের এই উক্তির জন্য (তাদের এই পরিণতি)। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি; কিন্তু তাদের এইরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা নিশ্চয় এই সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এই সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। ইহা নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ তাকে তঁার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৫৭-১৫৮)।

হাদিসমতে, ঈসা (আ.) চতুর্থ আসমানে রয়েছেন। কিয়ামতের পূর্বে তিনি দুনিয়ায় আসবেন হজরত মুহাম্মাদ (স.)–এর উম্মত হয়ে; অতঃপর তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজার পাশেই তাঁর দাফন হবে।

পরিশেষে, এ কথা না বললেই নয় যে, বিশ্বের সকল ধর্ম ও মহাপুরুষগণ সামগ্রিকভাবে বিশ্বশান্তি নিশ্চায়নের কথাই বলেছেন। খ্রিস্টধর্মও এর বিপরীত কিছু নয়। স্বীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ধর্মটি বিশ্বব্যাপী টিকে আছে দু হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে! তাই, মানব সভ্যতা ও বিশ্ব সভ্যতার ক্ষুদ্র অংশীজন হিসেবে আমাদের উচিত ধর্মটির প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করা, খ্রিস্টধর্মের মূল বাণী ও চেতনাগুলোকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব গঠন এবং সর্বত্র শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমরা সহানুভূতিশীল সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই উন্নতি করতে পারবো, নচেৎ সামাজিক অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করবে আমাদের সর্বোন্নতির পথ!

উল্লেখ্য, বিশদ এই বর্ণনার তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, MM Ali, The Bengali Reaction to Christian Missionary Activities 1833-1857, Chittagong, 1965; MA Laird, Missionaries and Education in Bengal 1793-1837, Oxford, 1972; J Thekkedath, History of Christianity in India: Vol.II – from the middle of the 16th century to the end of the 17th century (1542-1700), Bangalore, 1982; B Stanley, The History of the Baptist Missionary Society 1792-1992, Edinburgh, 1992; http://www.ebookbou.edu.bd/Books/Text/SOE/C-Ed/edc_3215/Unit-09.pdf; https://www.prothomalo.com/religion/কোরআনের-আলোকে-ঈসা-আ.-–এর-আবির্ভাব; https://bangladeshgurukul.com/বাংলাদেশে-খ্রিস্টধর্ম/; https://bonikbarta.net/home/news_description/207799/বাংলার-আদি-গির্জা-ও-খ্রিস্ট-সমাজ-; উইকিপিডিয়া আর্টিকেলসহ প্রভূত বিশিষ্ট লেখনী।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

ট্যাগ:

খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাব, প্রসার ও দর্শন

প্রকাশ: ১২:১৭:৪২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩

নওশীন নাওয়ার রাফা: সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষ ঐশ্বরিক অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এসেছে, যার ভিত্তিতে পৃথিবীর আদ্যোপান্ত সর্বস্থানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শত-সহস্র ধর্ম। স্থান-কাল ও পাত্রভেদে নির্দিষ্ট আচরণ ও অনুশীলন, নৈতিকতা, বিশ্বাস, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি, গ্রন্থ, পবিত্র স্থান, ভবিষ্যদ্বাণী, নীতিশাস্ত্র বা সংস্থার একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার নামই ধর্ম, যা মানবতাকে অতিপ্রাকৃত, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক উপাদানগুলোর সাথে সম্পর্কিত করে তোলে। হাজারো ধর্মের ভীড়ে স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরী করতে পারা ধর্মের সংখ্যা ইহলৌকিক অবস্থানে গুটিকয়েক। যদিও সকল ধর্মের মূল বাণী বা চেতনা শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া, তথাপি ধর্মীয় চৈতন্যে সনাতন (হিন্দু), খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং ইসলাম -এই চারটি ধর্মই মূলত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। তন্মধ্যে, খ্রিস্টধর্মের প্রেক্ষাপট, আবির্ভাব, প্রসার ও দর্শন নিয়েই এই গোটা লেখনীটি তৈরী করা হয়েছে।

খ্রিস্টধর্ম অব্রাহামীয় একেশ্বরবাদী এক ধর্ম, যা মধ্যপ্রাচ্যের (বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের উত্তরভাগে অবস্থিত) ঐতিহাসিক গালীল অঞ্চলের নাসরৎ শহর থেকে আগত ইহুদি বংশোদ্ভূত ধর্মীয় নেতা যিশুখ্রিস্টের জীবন ও শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয়। এই ধর্মের অনুসারীরা খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত। তারা একটি ধর্মীয় পুস্তকসমগ্র অনুসরণ করে, যার সামগ্রিক নাম বাইবেল। বাইবেলের পুস্তকগুলিকে দুইটি বড় অংশে ভাগ করা হয়েছে: পুরাতন নিয়ম ও নতুন নিয়ম। খ্রিস্টানরা এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে এবং আরও বিশ্বাস করে যে যিশু হলেন খ্রিস্ট (অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্বাচিত), যাঁর মশীহ (মানবজাতির ত্রাণকর্তা) হিসেবে আগমনের ব্যাপারে ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ হিব্রু বাইবেল তথা পুরাতন নিয়মে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে এবং নূতন নিয়মে তা বিবৃত হয়েছে। ২০১৫ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী বিশ্বে খ্রিস্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি, ফলে অনুসারীর সংখ্যা অনুযায়ী এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ধর্ম।

খ্রিস্টধর্ম সাংস্কৃতিকভাবে এর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যদেশীয় শাখাগুলির মধ্যে বিভক্ত এবং পরিত্রাণের প্রকৃতি ও প্রতিপাদন, যাজকাভিষেক, মণ্ডলীতত্ত্ব ও খ্রিস্টতত্ত্ব বিষয়ক মতাদর্শে বৈচিত্র্যময়। খ্রিস্টানদের সাধারণ ধর্মমত অনুসারে যিশু হলেন ঈশ্বরের পুত্র—মাংসে মূর্তিমান বাক্য—যিনি পরিচর্যা, দুঃখভোগ এবং ক্রুশারোহণ করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে মানবজাতির পরিত্রাণের জন্য মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন, যা বাইবেলে সুসমাচার বলে অবিহিত হয়েছে। মথি, মার্ক, লূক ও যোহন – এই চার সাধুর রচিত চারটি সুসমাচারের পাশাপাশি এর পটভূমি হিসেবে ইহুদি পুরাতন নিয়ম হল যিশুর জীবন ও শিক্ষার বিবরণী।

খ্রিস্ট ধর্মের প্রবর্তক যীশুখ্রিস্ট ইসরাঈলের জুদিয়া রাজ্যের বেথেলহেমে পবিত্র আত্মার মাধ্যমে অবিবাহিত অবস্থায় মেরী-র গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যসূত্রে জানা যায়, দম্পতি যোসেফ ও মেরী এর পুত্র সন্তানটিই যীশুখ্রিস্ট। ইহুদি পুরোহিতগণ যখন জানতে পারেন যীশুখ্রিস্ট ঈশ্বর প্রেরিত এবং ক্রমান্বয়ে তিনি যখন তার ধর্ম প্রচার করেন তখন তারা তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় গ্রহণ করেন। রোমান শাসকের সাহায্যে তারা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে। যীশুর মৃতদেহ সমাধিতে রাখা হলে সেখান থেকে তা অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তিনি একাধিকবার তার শিষ্যদের সাথে দেখা করে স্বর্গে গমন করেন।

ইসলাম ধর্মে যিশুখ্রিস্টকে হযরত ঈসা (আ) নামে অভিহিত করা হয় এবং তার মায়ের নাম মরিয়াম (আ)। উভয়ে সৃষ্টিকর্তা প্রেরিত নবী ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁর অশেষ কুদরতে কুমারী মরিয়ামের ঘরে শিশু ঈসা-কে ভূমিষ্ঠ করান এবং পরবর্তীতে জীবদ্দশায় চতুর্থ আকাশে উঠিয়ে নেন। শেষ জমানায় আবারও পৃথিবীতে তাঁর আগমন ঘটবে বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করে থাকেন।

যিশুখ্রিস্টের মুজিযা বা অলৌকিক কর্মকান্ডসমূহ নিয়েও রয়েছে বিস্তর বর্ণনা। তন্মধ্যে উল্লেখ্য কয়েকটি হচ্ছে, ১. অলৌকিকভাবে পিতা ছাড়া জন্মগ্রহণ; ২. জন্মের পর পরই নিজের এবং মায়ের সমর্থনে লোকদের সাথে কথা বলা; ৩. কাদামাটি দিয়ে তৈরি পাখির মধ্যে আল্লাহর নাম নিয়ে ফুঁ দিলে সেটি জীবিত হওয়া; ৪. আল্লাহর অনুগ্রহে হাতের ছোঁয়ায় জন্মান্ধ লোকদের দৃষ্টিশক্তি দান করা, কুষ্ঠ রোগের পূর্ণ নিরাময় দান; ৫. মানুষ ঘর থেকে যা খেয়ে আসে তা বলে দেওয়া ও অনুসারীদের জন্য জান্নাতী খাবার নিয়ে আসা এবং ৬. ইহুদি-পুরোহিত-রাজশক্তির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে তাঁকে জীবিত অবস্থায় আকাশে তুলে নেওয়া।

খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীর মধ্যভাগে লেভ্যান্টে (পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল) খ্রিস্টধর্মের উত্থান ঘটে। জেরুজালেম থেকে সমগ্র নিকট প্রাচ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রসারলাভ করেছিল সেসময়। আরাম, আসিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, ফিনিশিয়া, এশিয়া মাইনর, জর্ডান ও মিশর ছিল খ্রিস্টধর্মের প্রথম যুগের প্রধান কেন্দ্রসমূহ। ৭০ খ্রিস্টাব্দে যিরূশালেমের (জেরুজালেম) পতনের পর দ্বিতীয় মন্দিরভিত্তিক ইহুদিধর্মের অবসান ঘটে এবং খ্রিস্টধর্ম ক্রমশ ইহুদিধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সম্রাট মহান কনস্টান্টিন মিলান ফরমান (৩১৩ খ্রি.) জারি করার মাধ্যমে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মকে বৈধতা প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নিকেয়ার প্রথম পরিষদ (৩২৫ খ্রি.) আহ্বান করেন, যেখানে প্রারম্ভিক খ্রিস্টধর্মকে সংহত করা হয়, যা রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় আচারে (৩৮০ খ্রি.) পরিণত হয়।

খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টধর্ম রাজধর্মের স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। ৩০১ সালে আর্মেনিয়ায়, ৩১৯ সালে জর্জিয়ায়, ৩২৫ সালে আকসুমাইট সাম্রাজ্যে এবং ৩৮০ সালে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্ম রাজধর্মের স্বীকৃতি পায়। ৪৫১ সালে কাউন্সিল অফ ক্যালসেডন খ্রিস্টধর্মকে ওরিয়েন্টাল অর্থোডক্সি ও ক্যালসিডোনীয় খ্রিস্টধর্ম – এই দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত করে দেয়। ১০৫৪ সালে মহাবিভাজনের সময় ক্যালসিডনীয় খ্রিস্টধর্ম রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চে বিভক্ত হয়ে যায়। ষোড়শ শতাব্দীতে প্রোটেস্টান্ট সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি নতুন খ্রিস্টীয় সম্প্রদায়ের জন্ম হয়। পরে এই সম্প্রদায় থেকে অনেকগুলি পৃথক খ্রিস্টীয় সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়।

মধ্যযুগে রোমান ক্যাথলিক ও ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম সমগ্র ইউরোপে প্রসারিত হয়েছিল। নবজাগরণের সময় থেকে শুরু করে ইউরোপের আবিষ্কার যুগে খ্রিস্টধর্ম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হয়। এর ফলে এই ধর্ম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। বর্তমানে পৃথিবীতে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা দুইশ কোটি, যা বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশেরও বেশি।

আবিষ্কারের যুগের (১৫শ–১৭শ শতাব্দী) পর উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিভিন্ন প্রচারাভিযানের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম দুই আমেরিকা মহাদেশ, এশিয়া, ওশেনিয়া, সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা এবং বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সূত্রমতে, খ্রিস্টধর্মের চারটি বৃহত্তম শাখা হল ক্যাথলিক মণ্ডলী (১৩০ কোটি/৫০.১%), প্রতিবাদী মণ্ডলী (৯২ কোটি/৩৬.৭%), পূর্বদেশীয় সনাতনপন্থী মণ্ডলী (২৩ কোটি) ও প্রাচ্যদেশীয় সনাতনপন্থী মণ্ডলী (৬ কোটি ২০ লক্ষ/১১.৯%), যাদের মধ্যে ঐক্যের (বিশ্বব্যাপ্তিবাদ) বিভিন্ন প্রচেষ্টা জারি রয়েছে।

পাশ্চাত্যে খ্রিস্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা সাম্প্রতিককালে হ্রাস পেলেও এটি এখনও অঞ্চলটির (তথা পৃথিবীর) সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্ম, যেখানে প্রায় ৭০% জনগণ নিজেদের খ্রিস্টান হিসেবে চিহ্নিত করে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল মহাদেশ আফ্রিকা ও এশিয়ায় খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছু প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীর কয়েকটি অঞ্চলে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায়, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিপীড়নের শিকার।

ভিন্ন একটি সূত্রের লেখনী মতে, খ্রিস্টধর্ম প্রথমে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলিতে ইহুদিধর্মের একটি উপ-সম্প্রদায় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। খ্রিস্টের মৃত্যুর পরে তার আদি বারো শিষ্য জেরুসালেম থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়েন। কয়েক দশকের মধ্যে খ্রিস্টে বিশ্বাসী অনুসারীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বারো শিষ্যের বাইরে খ্রিস্টধর্মের বাণীর আদি প্রচারকদের মধ্যে সন্ত পৌল (৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ- আনু. ৬৭ খ্রিস্টাব্দ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; বাইবেলের নতুন নিয়মের ২৭টি পুস্তকের মধ্যে ১৩টিই তিনি রচনা করেন।

খ্রিস্টীয় ১ম শতকেই বারো শিষ্যদের সবার মৃত্যু হয়। এরপর ২য় ও ৩য় শতকে খ্রিস্টের বারো শিষ্যের উত্তরসূরী ধর্মবিদেরা খ্রিস্ট ধর্মের তত্ত্ব নির্মাণ ও প্রচার অব্যাহত রাখেন; তাদের রচনার অংশবিশেষ নতুন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসময় খ্রিস্টধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ অ-ইহুদি ধর্ম হিসেবে রোমান সাম্রাজ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। একই সাথে ধর্মটি মধ্যপ্রাচ্য, ইথিওপিয়া (আকসুম সাম্রাজ্য) ও আন্তঃককেশিয়ার বিশাল অংশে এবং এশিয়ার কিয়দংশে ছড়িয়ে পড়ে।

আকসুম সাম্রাজ্য প্রথম সাম্রাজ্য হিসেবে খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। ৪র্থ শতকে রোমান সম্রাট কোনস্তানতিন খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হন এবং তিনি ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে মিলানের রাজকীয় অধ্যাদেশবলে খ্রিস্টধর্মকে আইনবিরুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা বন্ধ করেন। এর প্রেক্ষিতে এটি সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্মে পরিণত হয়।

৩২৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কোনস্তানতিনের আহুত নিকায়েয়া-র (বর্তমান তুরস্কের ইজনিক শহর) ধর্মীয় সম্মেলনে খ্রিস্টধর্মের ধর্মীয় বিশ্বাসের সারসংক্ষেপ প্রথমবারের মত রচিত হয়। এতে বাইবেলে বর্ণিত পিতারূপী ঈশ্বর, পুত্ররূপী ঈশ্বর (যিশু) ও পবিত্র আত্মারূপী ঈশ্বর – এই তিন সত্তাই যে একই ঈশ্বরের তিন রূপ, এই ত্রিত্ববাদ ধারণাটি গৃহীত হয়।

বর্তমানে খ্রিস্টান মণ্ডলীগুলির সিংহভাগ ঈশ্বরের ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী; তবে মূলধারার বাইরে অনেক ছোট ছোট মণ্ডলী এতে বিশ্বাস করে না। ৫ম শতকে খ্রিস্টধর্মের নেতৃস্থানীয় ধর্মযাজকেরা ধর্মগ্রন্থসমগ্র বাইবেলের সংকলন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেন। মধ্যযুগে এসে ইউরোপের বাকি অংশগুলিরও খ্রিস্টধর্মায়ন ঘটে। সে সময় খ্রিস্টানরা মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতের অংশবিশেষেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে বাস করত।

আবিষ্কারের যুগের পরে উপনিবেশ স্থাপন ও জোরালো ধর্মপ্রচারণার সুবাদে খ্রিস্টধর্ম সাহারা-নিম্ন আফ্রিকা, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্বের অন্যত্র (যেমন পূর্ব এশিয়া বিশেষত ফিলিপাইন) ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে খ্রিস্টধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী বিরাজমান প্রধান ধর্ম।

২০১১ সালে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পিউ গবেষণাকেন্দ্রের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী খ্রিস্টানরা বিশ্বের সর্বব্যাপী এত বেশি ছড়িয়ে আছে যে কোনও একক একটি মহাদেশ বা অঞ্চল বিশ্ব খ্রিস্টান মণ্ডলীর কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে দাবী করতে পারে না। এটি একটি সাম্প্রতিক ঘটনা।

২০শ শতকের শুরুতে এসেও ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ খ্রিস্টান ইউরোপ মহাদেশে বাস করত এবং এ অবস্থাটি তার আগের এক সহস্রাব্দ থেকেই বিরাজ করছিল। ২১শ শতকের শুরুতে এসে বিশ্বের খ্রিস্টানদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ইউরোপে বাস করে, এবং এর বিপরীতে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি দুই আমেরিকা মহাদেশে বাস করে। এছাড়া প্রায় এক-চতুর্থাংশ খ্রিস্টান সাহারা-নিম্ন আফ্রিকাতে এবং প্রায় এক-অষ্টমাংশ এশিয়া মহাদেশ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাস করে।

ধর্ম মানব জীবনের একটি অপরিহার্য বিষয়। এটা মানুষকে জাগতিক, নৈতিক, মানবিক ও আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নে সহায়তা করে। যে জীবনে মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ থাকে না বা তার অভাব ঘটে, সে জীবন কখনও অর্থপূর্ণ হয়ে উঠে না। সে মানুষের জীবনে দেখা দেয় অনেক প্রকার বিপর্যয় এবং তারা অন্যের জীবনে ও সমাজে সৃষ্টি করে নানাবিধ অনর্থ এবং অনাচার। ধর্মকে ধারণ এবং অনুশীলন করেই মানুষ তার মানবিক গুণাবলীর স্ফুরণ ঘটাতে সক্ষম হয়, জীবনে জাগে ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শ্রদ্ধাশীলতা, বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধা ও শৃংখলাবোধ। ধর্মীয় তত্ত্ব ও তথ্য জ্ঞান মানুষকে দেয় আধ্যাত্মিক জীবনে পথনির্দেশ। খ্রিস্টধর্ম যীশু খ্রিস্টের শিক্ষা, আদেশ, নির্দেশ ও জীবনাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত। একেশ্বরবাদ এই ধর্মের ভিত্তি এবং পবিত্র বাইবেল ইহার মূল উৎস।

তাই সকলকেই খ্রিস্টধর্মের মূল শিক্ষা ও চেতনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠা ও গড়ে তোলা আমাদের কর্তব্য। তাতে আমরা মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুণাবলীতে সমৃদ্ধ হয়ে যেমন নিজেদের জীবনে সুখ শান্তি লাভ করতে পারবো, তেমনি অন্যের এবং সামাজিক জীবনেও বিভিন্ন সেবাম লক ও মঙ্গলজনক কাজকর্ম করে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনতে সক্ষম হবো। তাতে আমাদের সকলের মানবিক জীবন সার্থক হয়ে উঠবে।

খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা হল একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া ও একটি জীবনঘনিষ্ঠ দর্শন -এর সমাহার। পরিবর্তিত পরিবেশ ও মন মানসিকতার উপর নির্ভর করেই এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে সাজাতে হবে, যেন আমরা জীবনের লক্ষ্যে আকাংক্ষিত ফল লাভ করতে পারি। খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাস তদানীন্তন অন্য সকল ধর্ম হতে আলাদা এবং যুগান্তকারী দর্শন চিন্তার অধিকারী ছিলো। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,

একেশ্বরবাদ: খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় এবং তিনি সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। তার কোনো অংশীদার নেই; প্রেমময় ঈশ্বরবাদী: খ্রিস্টানদের মতে, ঈশ্বর হচ্ছেন Loving father বা প্রেমময় পিতা কিংবা Kind of God বা পরম দয়ালু প্রভু। আর মানুষ হচ্ছে Loving Child বা ভালোবাসার সন্তান; মোক্ষবাদী: খ্রিস্টানরা মনে করেন, যীশু ইচ্ছে করলে পাপীকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনি চিরকালের জন্যে সব পাপীকে ভালোবাসার পথ অনুসরণ করে মোক্ষ লাভের জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন; অমরত্ববাদী: খ্রিস্টধর্মে জীবাত্মার অমরত্বে বিশ্বাস পোষণ করা হয়। আত্মার মৃত্যু নেই। স্থানান্তর বা দেহান্তর রয়েছে; স্বর্গীয় দূতে বিশ্বাসী: খ্রিস্টধর্মে স্বর্গীয় দূত বা ফেরেশতায় বিশ্বাস স্থাপন করা হয়। তাঁরা নারী বা পুরুষ নন। তাদের নিদ্রা, খাওয়া বা বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না। তাঁরা শুধু সৃষ্টিকর্তার অনুগত্য করে; শেষ বিচারে বিশ্বাসী: শেষ বিচারের দিন মানুষকে আবার তাদের নিজ নিজ কর্মের হিসাব দেয়ার জন্য ডাকা হবে। মানুষ তার স্ব-স্ব কর্মফল হিসাবে সেদিন পুরস্কার বা শাস্তি গ্রহণ করবেন; শয়তান বা অশুভ শক্তিতে বিশ্বাসী: শুভ শক্তির পাশাপাশি পৃথিবীতে যে Evil বা অশুভ শক্তিও রয়েছে খ্রিস্টধর্ম এ বিশ্বাসও পোষণ করে। কারণ পৃথিবীতে যত অকল্যাণ ও পাপ কাজ সাধিত হয় তার সবই হয় অশুভ শক্তির কুপ্রভাবে; ত্রিত্ববাদী: খ্রিস্ট ধর্মমতে ঈশ্বরের তিন রূপ। এগুলো হলো, ক. God the Father বা পিতা ঈশ্বর, খ. God the Son বা পুত্র ঈশ্বর এবং গ. God the Holy spirit বা পবিত্র আত্মা ঈশ্বর। তবে ঈশ্বরের তিনটি দিক মাত্র, ভিন্ন ভিন্ন ঈশ্বর নয়। বরং এই তিনের সমন্বয়ই সর্বশক্তিমান এক ও অবিনশ্বর ঈশ্বর; প্রত্যাদিষ্ট ধর্ম: খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত প্রত্যাদেশে বিশ্বাসী। মানুষ নিজ থেকে ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম নয় যতক্ষন না ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে প্রত্যাদেশের মাধ্যমে জ্ঞান না দেন; অন্যান্য বৈশিষ্ট্য: খ্রিস্টধর্ম ঈশ্বরের পিতৃত্বে পূর্ণ বিশ্বাসী। যীশুখ্রিস্টের ত্রাণতত্ত্বে, মধ্যস্থতায় এবং তার অনুসরণে বিশ্বাসী। খ্রিস্টানরা কৃচ্ছতাবাদবিরোধী। ক্রুশ হচ্ছে তাদের ভালোবাসার চিহ্ণ। যে কেউ এই ধর্ম গ্রহণ করতে পারে বলে এটি একটি সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন ধর্ম হিসাবে স্বীকৃত।

খ্রিস্টানেরা বিশ্বাস করে একজন মাত্র ঈশ্বর স্বর্গ ও মর্ত্যের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। অর্থাৎ ঈশ্বর জগতের পিতা। পিতারূপী ঈশ্বর প্রতিটি মানুষকে সন্তানের মতো ভালোবাসেন এবং তার সাথে সম্পর্ক রাখতে চান। কিন্তু প্রতিটি মানুষ পাপ করার প্রবণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে (যার উৎস প্রথম মানব আদমের আদিপাপ)। এই সব ছোট-বড় পাপের কারণে মানুষ ও জগতের পিতা ঈশ্বরের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়।

খ্রিস্টানেরা বিশ্বাস করে যে যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বরেরই দ্বিতীয় একটি রূপ; তিনি ঈশ্বরের একমাত্র প্রকৃত পুত্র। ঈশ্বরের তৃতীয় আরেকটি রূপ হল পবিত্র আত্মা। পবিত্র আত্মা বিভিন্ন নবী বা ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে মানবজাতির সাথে যোগাযোগ করেছে। পবিত্র আত্মারূপী ঈশ্বর মানব কুমারী মেরির গর্ভে পুত্ররূপী ঈশ্বর তথা যিশুখ্রিস্টের জন্ম দেন, যার সুবাদে যিশুখ্রিস্ট রক্তমাংসের মানুষের রূপ ধারণ করে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নেমে আসেন। পবিত্র আত্মারূপী ঈশ্বরের সুবাদে পুত্ররূপী ঈশ্বর যিশুখ্রিস্ট পৃথিবীতে বহু অলৌকিক কাজ সম্পাদন করেন। শেষ পর্যন্ত যিশু ক্রুশবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণাভোগ করে মৃত্যুবরণ করে সমগ্র মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন।

কিন্তু তিন দিন পরে তিনি মৃত্যুকে পরাজিত করে পুনরুজ্জীবিত হন এবং স্বর্গে আরোহণ করেন যেখানে তিনি পিতারূপী ঈশ্বরের ডান পাশের আসনে অধিষ্ঠিত হন। ঈশ্বর উপহার হিসেবে সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। সময়ের যখন সমাপ্তি হবে, তখন যিশু আবার পৃথিবীতে ফেরত আসবেন এবং শেষ বিচারে সমস্ত মানবজাতির (মৃত বা জীবিত) বিচার করবেন। যারা যিশুখ্রিস্টে বিশ্বাস আনবে এবং ঈশ্বরের ক্ষমা গ্রহণ করবে, তারাই ভবিষ্যতে শেষ বিচারের দিনে পরিত্রাণ পাবে ও স্বর্গে চিরজীবন লাভ করবে। পুরাতন নিয়মের পুস্তকগুলিতে যে মসিহ বা ত্রাণকর্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে যে যিশুই সেই ত্রাণকর্তা। তারা যিশুকে একজন নৈতিক শিক্ষক, অনুকরণীয় আদর্শ এবং প্রকৃত ঈশ্বরকে উদ্ঘাটনকারী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করে।

এসব আলোচনায় ভুলে গেলে চলবেনা বাংলায় তথা ভারতবর্ষে খ্রিস্টধর্মের প্রসার বিশ্ব মানচিত্রের ইতিহাসে অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা। পরবর্তীতে ঔপনিবেশিকতাবাদ হতে শুরু করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্ভব সবকিছুর মূল ভিত্তি ছিলো খ্রিস্টধর্মের প্রসার।

বাংলার চার প্রধান ধর্মের মধ্যে খ্রিস্টধর্মের আগমনই সবার শেষে। মোটামুটি ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় ৫০০ বছর পর বাংলায় খ্রিস্ট ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। বাংলায় আগত প্রথম খ্রিস্টান ছিলেন সম্ভবত নেস্টরীয় খ্রিস্টানরা, তবে তারা ছিলেন পেশায় সওদাগর। এ দেশে ধর্ম প্রচারের অভিসন্ধি তাদের ছিল না বললেই চলে। তেমনি বাংলায় আসা আর্মেনীয় বণিকেরাও বেশি ধর্ম বিস্তারে মন দেয়নি।

বাংলায় খ্রিস্টধর্ম প্রথম প্রচারিত হয় সম্ভবত ষোলো শতকে পর্তুগিজদের মাধ্যমে। পরবর্তী দুশ বছর প্রধানত দুটি রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায় জেশিট ও অগাস্টিনিয়ানদের মাধ্যমে এর প্রচার কাজ চলে। পর্তুগিজরা সম্রাট আকবরের নিকট থেকে হুগলিতে বসতি স্থাপনের অনুমতি পেলে জেশিটরা ১৫৯৮-৯৯ খ্রিস্টাব্দে সেখানে একটি স্কুল ও একটি হাসপাতাল স্থাপন করে। আঠারো শতকের শেষদিকে পোপ কর্তৃক তাদের প্রচার বন্ধের পূর্ব পর্যন্ত তারা বাংলায় ধর্ম প্রচার করে।

বাংলায় খ্রিস্টধর্মীয় কর্মকান্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করে অগাস্টিনিয়ানরা। তারা ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে একটি গির্জা স্থাপন করে, সেখান থেকে ঢাকাসহ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করা হয়। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হুগলিতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০০, যাদের মধ্যে ছিল পর্তুগিজ, তাদের ইউরেশিয়ান বংশধর এবং ক্রীতদাসসহ অন্যান্য ধর্মান্তরিতরা। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান হুগলি আক্রমণ করলে গির্জাটি ধ্বংস হয়; তবে পরবর্তীকালে অগাস্টিনিয়ানরা ব্যান্ডেলে বসতি স্থাপনের অনুমতি পায় এবং সেখানে একটি গির্জা নির্মাণ করে, যা এখনও বর্তমান।

পর্তুগিজরা আরাকানরাজের সহায়তায় ষোলো শতকেই চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করে। অগাস্টিনিয়ানরা সেখানে ১৬২১ খ্রিস্টাব্দে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং কয়েক হাজার লোককে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দেয়, যাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে দস্যুতাকালে ধরা হয়েছিল। পরে সতেরো শতকে নগরী তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এর আগে ভূষণার (যশোর) রাজপুত্র খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে অ্যান্টোনিও ডি রোজারিও নাম গ্রহণ করেন এবং প্রধানত নিম্নবর্ণের ২০,০০০ হিন্দুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেন। সতেরো শতকের নববইয়ের দশকে বাংলায় ১৩টি অগাস্টিনিয়ান গির্জা ছিল।

দীক্ষিত খ্রিস্টানদের অধিকাংশকেই প্রাথমিক কিছু নিয়ম-কানুন ও উপদেশ দেওয়া হতো এবং তারা গুরুত্বপূর্ণ নতুন কেন্দ্রগুলিতে অভিবাসী হতে চাইত; এমন একটি কেন্দ্র ছিল কলকাতা, যেখানে ইংরেজরা ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে বসতি স্থাপন করে। অগাস্টিনিয়ানরা সেখানে একটি ক্ষুদ্র উপাসনালয় স্থাপন করেছিল। ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে ফরাসিরা খ্রিস্টানদের সেবার জন্য চন্দননগরে একজন জেশিউটকে নিয়োগ করে। আর্মেনিয়ানরা ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে চুঁচুড়ায় একটি গির্জা স্থাপন করে এবং তার পরপর কলকাতা ও ঢাকায়ও দুটি গির্জা স্থাপিত হয়।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার প্রতিনিধি ও কর্মচারীদের জন্য যাজক নিযুক্ত করে এবং ১৮১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ব্রিটিশ সরকার অনুমোদিত গির্জায় বিশপের পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে জনগণের বিরোধিতার ভয়ে কোম্পানি প্রচার কাজ বন্ধ রাখে; পরে অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে তা চালু করা হয়। তবে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির উইলিয়ম কেরী এ দেশে আসার পর ১৭৯৩ থেকেই প্রটেস্টানদের কর্মকান্ড চলতে থাকে।

১৮০০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম কেরী শ্রীরামপুরের ডেনিশ বসতিতে জশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়ম ওয়ার্ডর যোগদান করেন। শ্রীরামপুরের এ পাদ্রী ত্রয়ী খ্রিস্টধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। তাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন, যার পাঠ্যসূচিতে আধুনিক বিজ্ঞান, ভূগোল ও ইতিহাসের প্রাথমিক পাঠ অন্তর্ভুক্ত হয়। তাঁরা এসব স্কুলের জন্য বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত প্রেস থেকে সেসব প্রকাশ করেন।

১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠায় তাঁরা উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করেন। এ সোসাইটি প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ব্যবহারের জন্য উপর্যুক্ত গ্রন্থসমূহের হাজার হাজার কপি মুদ্রণ করে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীরামপুর কলেজ, যেখানে খ্রিস্টান-অখ্রিস্টান ছাত্ররা কলা, বিজ্ঞান ও ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বন্ধে উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। ডেনমার্কের রাজা ষষ্ঠ ফ্রেড্রিক ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের এক সনদে এ কলেজটি অনুমোদন করেন। এটি তখন একটি অসাধারণ তথ্যভান্ডারে পরিণত হয়। কিন্তু উনিশ শতকের শেষদিকে এর অবস্থার অবনতি ঘটে এবং ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট হলওয়েল কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত হলে এটি ভারতে ধর্মশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।

পাঠ্যপুস্তক ছাড়া শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্টরা বাংলা ভাষার উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিদেশিদের বাংলা শেখা ও দেশিদের খ্রিস্ট সাহিত্য পড়ার সুবিধার্থে তাঁরা একটি অভিধান ও একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ প্রণয়ন করেন এবং বাইবেলেরও অনুবাদ করেন। তাঁরা দিগ্দর্শন ও সমাচার দর্পণ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা সংবাদপত্রের সূচনা করেন; দি স্টেটসম্যান পত্রিকার পূর্বপুরুষ দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া প্রকাশও তাঁদের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

কেরী শ্রীরামপুরে উদ্ভিদবিদ্যা ও কৃষিবিদ্যায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি সেখানে বাগান তৈরি করেন এবং বিদেশ থেকে বীজ এনে নতুন জলবায়ু গ্রহণে সক্ষম বৃক্ষ উৎপাদন করেন। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটি অব ইন্ডিয়া স্থাপনেও নেতৃত্ব দেন। শ্রীরামপুরের যাজকরা সমকালীন হিন্দুসমাজে প্রচলিত অমানবিক আচরণ, যেমন সাগরদ্বীপে শিশুহত্যা, সতীদাহ ইত্যাদির বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও সরকারকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন; এসবের ওপর তাঁরা একটি গবেষণাও চালিয়েছিলেন।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের পরে বাংলায় ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির অনুসরণে যে প্রটেস্টান্ট মিশনারি সোসাইটিগুলি কাজ করে সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: লন্ডন মিশনারি সোসাইটি, চার্চ মিশনারি সোসাইটি এবং চার্চ অব স্কটল্যান্ড। চার্চ মিশনারি সোসাইটি ছিল ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এটি ভারতে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালনকারী মেরী অ্যান কুককে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রাথমিক সমর্থন জানিয়ে আসছিল।

এরপর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে স্কটিশ পাদ্রী আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতা আসেন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য নতুন পর্যায়ের কাজ শুরু করেন। তিনি একটি স্কুল স্থাপন করেন যা দ্রুত ও দীর্ঘস্থায়ী সাফল্য লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত স্কটিশচার্চ কলেজ নামে সুপরিচিত হয়। ডাফ আবৃত্তিমূলক শিক্ষা অনুমোদন করেন এবং ছাত্রদের মধ্যে আগ্রহ ও বোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরু দায়িত্বের ওপর জোর দেন। তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ মানব তৈরি এবং শরীরচর্চা ও খেলাধুলার সুযোগ তৈরির প্রতিও উৎসাহী ছিলেন। ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী ও অনমনীয়। অন্যান্য মিশনারিরাও এ কাজ শুরু করেছিলেন এবং তাঁর এ উদ্যোগের কারণেই সরকার ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলায় খ্রিস্টধর্মের প্রভাব ও অবদানও অনস্বীকার্য। আধুনিক বাংলার উন্নয়নে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের ভাষাভিত্তিক ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ড এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে তাঁরা প্রধানত ধর্মযাজকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসব করতেন। তাঁরা মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে, তাদের মুক্তি একমাত্র খ্রিস্টধর্মেই নিহিত, যদিও এ ক্ষেত্রে তাঁদের সফলতা ছিল খুবই কম।

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যাপ্টিস্টরা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারা বাংলায় মিশন স্থাপন করা সত্ত্বেও তিন হাজারের বেশি লোককে ধর্মান্তরিত করতে পারেননি; তাও তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ছিল অন্য খ্রিস্টান চার্চের লোক। ধর্মান্তর প্রক্রিয়া পরিবার ও সমাজ থেকে বহিষ্কার এবং গ্রাম এলাকায় জমিদারদের বিরোধিতার দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়।

আলেকজান্ডার ডাফ এ ব্যাপারে কলকাতার বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন, যাঁরা ইতোমধ্যেই পাশ্চাত্যের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন; কেউ কেউ আবার ইতোমধ্যে ধর্মান্তরিতও হয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে কয়েকজন, বিশেষত কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন।

তখন গণধর্মান্তর ছিল একটি অস্বাভাবিক ব্যাপার; তবে এরূপ একটি ঘটনা ঘটেছিল উনিশ শতকের তিরিশের দশকের শেষদিকে কৃষ্ণনগর অঞ্চলে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে। এ সম্প্রদায়ের অনেক মতবাদ খ্রিস্টধর্মেরই অনুরূপ; উপরন্তু এ সম্প্রদায়ের লোকেরা ছিল অর্থনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যায় আক্রান্ত; সুতরাং তারা সহজেই পাদ্রীদের প্রচারিত খ্রিস্টধর্মে আকৃষ্ট হয়।

ব্যাপ্টিস্টরা বরিশাল এলাকায় বেশ সাফল্য অর্জন করে। সেখানে প্রধানত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের লোকেরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪২৭৮-এ। কিন্তু এ খ্রিস্টান সম্প্রদায় ছিল দরিদ্র এবং দীর্ঘকাল মিশনারি সোসাইটির সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।

উনিশ শতকের অধিকাংশ সময় জুড়েই হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের প্রতি পাদ্রিদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমালোচনামূলক ও বিরোধমূলক, যা স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে এবং চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা বিরুদ্ধ মতবাদের সৃষ্টি হয়। পাদ্রীদের এ কর্মকান্ড হিন্দুধর্মের সংস্কার আন্দোলনকে উৎসাহিত করে, যার ফলে ব্রাহ্মসমাজ, তত্ত্ববোধিনী সভা ইত্যাদির সৃষ্টি হয়। পাদ্রীরা তখন মুসলমানদের সঙ্গে অধিক ধর্মীয় সাদৃশ্য দেখতে পান, যদিও ধর্মান্তরীকরণে তাদের নিকট থেকে বাধাও পেয়েছেন অনুরূপ।

তবে পাদ্রীরা পল্লীর দরিদ্র জনগণের দুরবস্থা দেখে যথার্থই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই চার্চ মিশনারি সোসাইটির রেভারেন্ড জেমস লং ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করানোর ব্যবস্থা করেন। এতে নীলচাষের অত্যাচার উৎপীড়ন চিত্রিত হয়েছে এবং এ কারণে নীলকরদের দ্বারা অভিযুক্ত হয়ে তিনি কিছুকাল কারাবাস করেছিলেন।

ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার কারণে লং ছিলেন উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ভারতীয় ব্রিটিশদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তবে এ শতকের শেষদিকে পাদ্রীরা হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের প্রতি অধিকতর সহানুভূতি দেখাতে শুরু করেন। জে.এন ফারকুহরের দৃষ্টান্তে একথা প্রমাণিত হয়। তিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার YMCA-এর সেক্রেটারি হয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের প্রতি ফারকুহরের এ উৎসাহ ইসলাম ধর্মের প্রতি ব্যাপ্টিস্ট বেভান জোনসকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকায় কাজ করেছেন।

১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে রোমান ক্যাথলিক চার্চ শক্ত ভিতের ওপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় পর্তুগিজ শাসনের বাইরে পোপ কর্তৃক তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে একজন যাজক নিযুক্ত হন। বেলজিয়াম যাজকরা এ ধরনের কাজ শুরু করেন ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে। তাঁরা কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আর্চবিশপের অধীনে কলকাতায় একটি ধর্মীয় প্রশাসনিক এলাকা তৈরি হয়; সেসঙ্গে পূর্ববঙ্গে হলিক্রস ফাদারসহ কতিপয় নতুন নিয়ম-কানুনও প্রবর্তিত হয়।

পাদ্রীরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রাবাসসহ শিক্ষাখাতে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে থাকেন। বাংলায় ইংল্যান্ড সরকার অনুমোদিত মৈত্রী সঙ্ঘ অক্সফোর্ড মিশনও ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার দক্ষিণে বেহালায় একটি কারিগরি বিদ্যালয় গড়ে তোলে। কিছু কিছু চিকিৎসা কর্মকান্ডও হাতে নেওয়া হয়। ১৯০৮ সালে চন্দ্রঘোনায় একটি ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি হাসপাতাল খোলা হয়। এরপরে একটি কুষ্ঠ নিরাময় কেন্দ্র এবং সবশেষে বল্লভপুরে একটি চার্চ মিশনারি সোসাইটি হাসপাতালও স্থাপন করা হয়।

কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতে ভারতীয়দের দ্বারাই খ্রিস্টধর্ম ব্যাপকভাবে প্রচার করা সম্ভব; তবে এর কর্তৃত্ব থাকবে বিদেশি মিশনারিগুলির হাতেই। এ কারণে শতবর্ষ পরেও খ্রিস্টধর্মকে বিদেশাগত বলেই মনে হয়েছে এবং বর্তমানে জাতীয় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ব্যাপকভাবে ভারতীয়করণের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাগের পর ঢাকা রোমান ক্যাথলিক আর্চবিশপ এবং অ্যাংগলিকান বিশপের কর্মকান্ডের কেন্দ্র হয়। পশ্চিমবঙ্গসহ উত্তর ভারত এবং পাকিস্তানে অ্যাংগলিকান ও আরও অনেক প্রটেস্টান গোষ্ঠীর মধ্যে মিলনের এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ লক্ষ করা যায়। উভয় দেশে এটা ঘটেছিল ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে।

এরপর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন অ্যাংগলিকান ও যাজক সম্প্রদায়ের সম্মিলনে চার্চ অব বাংলাদেশ গঠিত হয়। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে এর দুজন বিশপ এবং প্রায় ১৪,০০০ জন সদস্য ছিল। এর মধ্যে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাপ্টিস্ট সংঘ) কর্তৃক সৃষ্ট উপাসকমন্ডলীও রয়েছে। বাংলাদেশে বৃহত্তম খ্রিস্টান সম্প্রদায় হচ্ছে রোমান ক্যাথলিক, যাদের সংখ্যা বাংলাদেশে মোট পাঁচ লক্ষ খ্রিস্টান জনসংখ্যার মধ্যে দু লাখেরও বেশি।

এসবের পাশাপাশি আমাদের পালিত ইসলাম ধর্মেও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম বিশ্বের দুটি বৃহত্তম ধর্ম, যার উভয়টিতে দুই বিলিয়নের বেশি অনুসারী রয়েছে। উভয় ধর্মই ইব্রাহিমীয় ধর্ম এবং একেশ্বরবাদী হিসাবে বিবেচিত হয়, যা মধ্যপ্রাচ্যে উদ্ভূত। খ্রিস্টধর্ম খ্রিস্টীয় ১লা শতাব্দীতে দ্বিতীয় মন্দির ইহুদি ধর্ম থেকে বিকশিত হয়েছিল। এটা যীশু খ্রীষ্টের জীবন, শিক্ষা, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যারা এটি অনুসরণ করে তাদের খ্রিষ্টান বলা হয়। ৭ম শতাব্দীতে ইসলামের বিকাশ ঘটে। ইসলামের প্রতিষ্ঠা মুহাম্মদের শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত, যা আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের প্রকাশ। যারা এর অনুসরণ করে তাদের মুসলমান বলা হয় যার অর্থ “ঈশ্বরের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা।”

ইসলাম যীশুকে আল-মশীহ বলে মনে করে, যাকে বনি ইসরাইল (ইস্রায়েলের সন্তান) একটি নতুন আপ্তবাক্য দিয়ে পথ দেখানোর জন্য পাঠানো হয়েছিল আল-ইনযিল। খ্রিস্টধর্ম ও বিশ্বাস করে যে যীশু হিব্রুয় শাস্ত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করা মশীহা। কিন্তু, খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের অনেক বেশি কেন্দ্রবিন্দু হল যীশু হলেন অবতারিত ঈশ্বর, বিশেষত, ত্রিত্ব ঈশ্বরের অন্যতম হিপস্পদ, ঈশ্বর পুত্র। যীশুর প্রতি বিশ্বাস খ্রিষ্টান এবং ইসলামি ধর্মতত্ত্ব উভয়েরই একটি মৌলিক অংশ।

খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের বিভিন্ন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। খ্রিস্টধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল এবং ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে আল-ইঞ্জিলকে বিকৃত করা হয়েছিল বা খ্রিষ্টান নতুন নিয়ম গঠনের জন্য পরিবর্তন করা হয়েছিল। এর বিপরীতে, খ্রিষ্টানদের কুরআন সম্পর্কে একক ধারণা নেই, যদিও বেশিরভাগই বিশ্বাস করে যে এটি বানোয়াট বা ধর্মত্যাগী কাজ। উভয় গ্রন্থে যিশুর জীবন ও কর্মের বিবরণ এবং মরিয়মের মাধ্যমে যিশুর কুমারী জন্মের মতো মিল রয়েছে; তবুও, এই ঘটনাগুলির কিছু বাইবেল এবং কুরআনীয় বিবরণ ভিন্ন।

হজরত মরিয়ম (আ.) এবং তাঁর পুত্র হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘আর বর্ণনা কর এই কিতাবে উল্লিখিত মরিয়মের কথা, যখন সে তার পবিরবর্গ হতে পৃথক হয়ে নিরালায় পূর্বদিকে এক স্থানে আশ্রয় নিল, অতঃপর উহাদিগ হতে সে পর্দা করল। অতঃপর আমি তার নিকট আমার রুহকে পাঠালাম, সে তার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল।’

মরিয়ম বলল, “আল্লাহকে ভয় করো যদি তুমি মুত্তাকী হও, আমি তোমা হতে দয়াময়ের শরণ নিচ্ছি।” সে বলল, “আমি তো তোমার প্রতিপালক প্রেরিত, তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করার জন্য।” মরিয়ম বলল, “কেমন করে আমার পুত্র হবে? যখন আমাকে কোনো পুরুষ স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণীও নই।” সে বলল, “এই রূপেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন—ইহা আমার জন্য সহজসাধ্য এবং আমি উহাকে এই জন্য সৃষ্টি করব যেন সে হয় মানুষের জন্য এক নিদর্শন ও আমার নিকট হতে এক অনুগ্রহ; ইহা তো এক স্থিরকৃত ব্যাপার।”

অতঃপর সে গর্ভে উহাকে ধারণ করল; অতঃপর তৎসহ এক দূরবর্তী স্থানে চলে গেল; প্রসববেদনা তাকে এক খর্জুর-বৃক্ষ তলে আশ্রয় লইতে বাধ্য করল। সে বলল, হায়! ইহার পূর্বে আমি যদি মরে যেতাম ও লোকের স্মৃতি হতে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হতাম। ফেরেশতা তার নিম্ন পার্শ্ব হতে আহ্বান করে তাকে বলল, “তুমি দুঃখ করো না, তোমার পাদদেশে তোমার প্রতিপালক এক নহর সৃষ্টি করেছেন। তুমি তোমার দিকে খর্জুর-বৃক্ষকে নাড়া দাও, উহা তোমাকে সুপরিপক্ক তাজা খর্জুর দান করবে। সুতরাং আহার করো, পান করো ও চক্ষু জুড়াও।”

মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখো তখন বলো, “আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতা অবলম্বনের রোজার মান্নত করেছি সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সহিত বাক্যালাপ করব না।” অতঃপর সে সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের নিকট উপস্থিত হলে; উহারা বলল, “হে মরিয়ম! তুমি তো এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে আছো। ‘হে হারুন-ভগ্নি! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ছিলেন না ব্যভিচারিণী।”

অতঃপর মরিয়ম সন্তানের প্রতি ইঙ্গিত করল। উহারা বলল, “যে কোলের শিশু তার সহিত আমরা কেমন করে কথা বলব?” সে (শিশু ঈসা নবী আ.) বলল, “আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়াছেন, আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন, তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মাতার প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে করেননি উদ্ধত ও হতভাগ্য; আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি উত্থিত হব।” এই-ই হলো মরিয়ম তনয় ঈসা (আ.)। আমি বললাম সত্য কথা, যে বিষয়ে উহারা বিতর্ক করে।’ (সূরা: ১৯ মরিয়ম, আয়াত: ১৬-৪০)।

কোরআন কারিমে হজরত ঈসা (আ.)–এর নাম বিভিন্ন প্রসঙ্গে ২৫ বার উল্লেখ হয়েছে। হজরত মরিয়ম (আ.)–এর নামে কোরআনুল কারিমে একটি স্বতন্ত্র সুরাও রয়েছে এবং মরিয়ম শব্দটি কোরআন কারিমে নানানভাবে ৩৫ বার উল্লিখিত হয়েছে। হজরত ঈসা (আ.)–এর সৃষ্টি হজরত আদম (আ.)–এর মতো। ‘আল্লাহর নিকট নিশ্চয় ঈসা (আ.)–এর দৃষ্টান্ত আদম (আ.)–এর দৃষ্টান্তসদৃশ। তিনি তাকে মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছিলেন; অতঃপর তাকে বলেছিলেন “হও”, ফলে সে হয়ে গেল।’ (সুরা-৩, আল ইমরান, আয়াত: ৫৯)।

হজরত ঈসা (আ.)–এর জন্ম যেমন বিস্ময়কর, তাঁর পুনরাবির্ভাবও হবে বিস্ময়করভাবে। তাঁর সম্পর্কে কোরআন মাজিদে আছে, ‘আর “আমরা আল্লাহর রাসুল মারইয়াম তনয় ঈসা মাসিহকে হত্যা করেছি”—তাদের এই উক্তির জন্য (তাদের এই পরিণতি)। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি, ক্রুশবিদ্ধও করেনি; কিন্তু তাদের এইরূপ বিভ্রম হয়েছিল। যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা নিশ্চয় এই সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এই সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ব্যতীত তাদের কোনো জ্ঞানই ছিল না। ইহা নিশ্চিত যে তারা তাকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ তাকে তঁার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা-৪ নিসা, আয়াত: ১৫৭-১৫৮)।

হাদিসমতে, ঈসা (আ.) চতুর্থ আসমানে রয়েছেন। কিয়ামতের পূর্বে তিনি দুনিয়ায় আসবেন হজরত মুহাম্মাদ (স.)–এর উম্মত হয়ে; অতঃপর তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন এবং হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজার পাশেই তাঁর দাফন হবে।

পরিশেষে, এ কথা না বললেই নয় যে, বিশ্বের সকল ধর্ম ও মহাপুরুষগণ সামগ্রিকভাবে বিশ্বশান্তি নিশ্চায়নের কথাই বলেছেন। খ্রিস্টধর্মও এর বিপরীত কিছু নয়। স্বীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ধর্মটি বিশ্বব্যাপী টিকে আছে দু হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে! তাই, মানব সভ্যতা ও বিশ্ব সভ্যতার ক্ষুদ্র অংশীজন হিসেবে আমাদের উচিত ধর্মটির প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করা, খ্রিস্টধর্মের মূল বাণী ও চেতনাগুলোকে ধারণ করে অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব গঠন এবং সর্বত্র শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়া। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমরা সহানুভূতিশীল সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলেই উন্নতি করতে পারবো, নচেৎ সামাজিক অস্থিরতা ক্রমশ গ্রাস করবে আমাদের সর্বোন্নতির পথ!

উল্লেখ্য, বিশদ এই বর্ণনার তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, MM Ali, The Bengali Reaction to Christian Missionary Activities 1833-1857, Chittagong, 1965; MA Laird, Missionaries and Education in Bengal 1793-1837, Oxford, 1972; J Thekkedath, History of Christianity in India: Vol.II – from the middle of the 16th century to the end of the 17th century (1542-1700), Bangalore, 1982; B Stanley, The History of the Baptist Missionary Society 1792-1992, Edinburgh, 1992; http://www.ebookbou.edu.bd/Books/Text/SOE/C-Ed/edc_3215/Unit-09.pdf; https://www.prothomalo.com/religion/কোরআনের-আলোকে-ঈসা-আ.-–এর-আবির্ভাব; https://bangladeshgurukul.com/বাংলাদেশে-খ্রিস্টধর্ম/; https://bonikbarta.net/home/news_description/207799/বাংলার-আদি-গির্জা-ও-খ্রিস্ট-সমাজ-; উইকিপিডিয়া আর্টিকেলসহ প্রভূত বিশিষ্ট লেখনী।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়