ভুটান ও চিনের সীমান্তে থাকা ডোকলাম নিয়ে জট কাটাতে বেজিংয়ের মতও সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ভুটানি প্রধানমন্ত্রী। এ হেন বিতর্কিত মন্তব্যের এক সপ্তাহের মধ্যেই সোমবার থেকে তিন দিনের জন্য নয়াদিল্লির আতিথ্যে ভুটানের রাজা জিগমে খেসর নামগিয়েল ওয়াংচুক। ভুটান সরকারের বিভিন্ন কর্তার পাশাপাশি তাঁর প্রতিনিধি দলে রয়েছেন সে দেশের বিদেশমন্ত্রী তান্ডি দোরজি। ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি।
সোমবার বিকেলে ওয়াংচুক দিল্লি পৌঁছনোর পরে সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক রাজার। আলোচনায় চিন নিয়ে ভারতের উদ্বেগের কথা এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্যের বিষয়টি উঠে আসবে বলেই কূটনৈতিক সূত্রে জানা গিয়েছে। ভারত ওই মন্তব্যের কোনও পাল্টা প্রতিক্রিয়া এখনও জানায়নি ঠিকই, কিন্তু বিষয়টি নয়াদিল্লির কাছে যে আদৌ স্বস্তিদায়ক নয়, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দেওয়া হবে রাজাকে।
ভারতের অভিযোগকে কার্যত অস্বীকার করে এর আগে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেছিলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে যা-ই প্রকাশিত হয়ে থাকুক, ভুটানি এলাকায় চিন কোনও নির্মাণকার্য চালাচ্ছে না। আমাদের এলাকায় অনুপ্রবেশ ঘটেনি। আন্তর্জাতিক সীমান্তে কোন এলাকা আমাদের, তা আমরা জানি।’’
তাঁর বক্তব্য, ‘‘ডোকলাম সমস্যায় তিনটি পক্ষ রয়েছে। কোনও দেশই ছোট বা বড় নয়। তিন দেশের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ।” বিশেষজ্ঞদের মতে, শেরিংয়ের এই বক্তব্যের সুর ২০১৯ সালে তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকারের সুর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তখন শেরিং স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও দেশেরই ত্রিদেশীয় সীমান্তের কাছে একতরফা কোনও পদক্ষেপ করা উচিত নয়। নাম না করে তিনি চিনের দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
২০১৭ সালে ডোকলামে ভারতীয় ও চিনা সেনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল। ওই এলাকায় ত্রিদেশীয় সীমান্ত বর্তমানে রয়েছে বাটাং লা নামে একটি এলাকায়। এই এলাকার উত্তরে চিনের চুম্বি উপত্যকা। দক্ষিণ ও পূর্বে ভুটান। পশ্চিমে রয়েছে ভারতের সিকিম। বেজিংয়ের দাবি, প্রকৃত ত্রিদেশীয় সীমান্ত হওয়া উচিত বাটাং লা থেকে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে মাউন্ট জিপমোচি শৃঙ্গ ও ঝাম্পেরি শৈলশিরার কাছে। এই দাবি মানতে রাজি নয় ভারত। ঝাম্পেরি শৈলশিরা থেকে সরাসরি নজর রাখা যায় ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সঙ্গে সংযোগকারী শিলিগুড়ি করিডরের উপরে। ফলে কৌশলগত ভাবে ওই এলাকা ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য, ভূটান রাজের এই সফর দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ভুটানের শীর্ষ ব্যবসায়িক অংশীদার। এছাড়াও ভুটানের রাজার সফরের সময় উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা পর্যালোচনা করবে এবং দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ভুটানের রাজার সঙ্গে থাকবেন ভুটানের বিদেশমন্ত্রী ডাঃ তান্ডি দরজি এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এমনটাই জানানো হয়েছে বিদেশমন্ত্রকের পক্ষ থেকে। জানিয়ে রাখা ভাল, দুই দেশের বিশেষ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা রয়েছে যা পারস্পরিক বিশ্বাস এবং বোঝাপড়ার দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। বলা বাহুল্য যে, রাজা জিগমে ওয়াংচুকের সফর ভারত ও ভুটান উভয়কেই দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সম্পূর্ণ পরিসরের মূল্যায়ন করার সুযোগ দেবে। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর আমন্ত্রণে ভুটান রাজার এই সফর।
দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত উচ্চ-পর্যায়ের তথ্য আদান-প্রদানের দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্যকে সামনে রেখে ভুটানের রাজা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করবেন। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ভুটানের রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভুটান যখন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু করেছিল তখন থেকেই ভারত ভুটানের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রসারিত করে আসছে। ১২ তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার জন্য, ভারত ভুটানকে ৪,৫০০কোটি দিয়ে বিভিন্ন বহু-ক্ষেত্রীয় প্রকল্প-আবদ্ধ সহায়তা, ছোট উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সাহায্য করেছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে, ভারত সরকার ভারতের সঙ্গে ভুটানের দ্বিপাক্ষিক এবং ট্রানজিট বাণিজ্যের জন্য সাতটি নতুন বাণিজ্য রুট খোলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে। ভুটান থেকে ভারতে ১২টি কৃষি পণ্যের আনুষ্ঠানিক রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার জন্য নতুন বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদান করা হয়। খবর: ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক