নওশীন নাওয়ার রাফা: শিল্প এবং ধর্ম- দুটিই মানব সভ্যতার আদিম প্রবৃত্তি। প্রবৃত্তির বেশ কিছু অর্থ আমরা পেতে পারি; যেমন, নিযুক্ত, রত হওয়া, অভিরুচি, ঝোঁক ইত্যাদি। প্রদত্ত যে অর্থই আমরা গ্রহণ করি না কেন, প্রবৃত্তি হলো মানুষের এক ধরণের প্রবণতা, যা মানুষ স্বীয় জন্মের সঙ্গে নিয়ে আসে। ফলত, শিল্প-সাহিত্য ও ধর্মকে যদি সহজাত প্রবৃত্তি বলা হয়, তাহলে আরো সঠিকভাবে তা উপস্থাপন করা যেতে পারে।
প্রাচীন হতে অদ্যবধি ইতিহাস ও ধারা জুড়ে আমরা দেখতে পাই, শিল্পচর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ধর্মীয় উপাদান। যুগে যুগে বিভিন্ন সভ্যতার মানুষ স্বীয় ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশের ক্ষেত্রে শিল্পের ব্যবহার করেছে। কিংবা, ভিন্নার্থে, স্বীয় শিল্পের বিকাশে মানুষ ধর্ম বিশ্বাসের অবয়ব প্রকাশ করেছে।
এছাড়া, আধ্যাত্মিক বার্তা প্রদান এবং ঐশ্বরিক ও মানুষের মধ্যে সংযোগ তৈরি করার মাধ্যম হিসেবেও শিল্পের প্রভূত ব্যবহার হয়েছে। তাই, সনাতন, খ্রিস্টান, ইসলাম এবং বৌদ্ধসহ প্রতিটি ধর্মীয় সভ্যতার বিবর্তন সংশ্লিষ্ট সমাজের শিল্পকলার বিশ্লেষণ করলেই খুঁজে পাওয়া যায়। এই লিখাটিতে মূলত প্রাথমিক খ্রিষ্টান যুগের শিল্পকলায় খ্রিস্টধর্মের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।
প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প, যাকে প্যালেও-খ্রিস্টান শিল্প বা আদিম খ্রিস্টান শিল্পও বলা হয়, মূলত খ্রিস্ট ধর্মের সূচনালগ্ন থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ব্যপ্ত ছিলো। বেশ কয়েকজন ঐতিহাসিকের মতে, আর্লি খ্রিস্টান আর্ট বা প্রাথমিক খ্রিষ্টান শিল্পকলা বলতে ২৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে খ্রিস্টানদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি করা শিল্পকর্মগুলোকে বুঝায়।
তবে, খ্রিস্টান শিল্প ঠিক কখন স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করে, তা জানা কঠিন। ১০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে খ্রিস্টানরা একটি নির্যাতিত জাতি হিসেবেই বাস করছিলো; ফলত, উচ্চ টেকসই শিল্পকর্ম তৈরি ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যেহেতু এই সময়ে খ্রিস্ট ধর্ম মূলত একটি নিম্নবর্গের উঠতি ধর্ম হিসেবে টিকে ছিল, তাই এসময় শিল্পের তেমন প্রসার না ঘটার প্রধান কারণ হতে পারে- যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা অর্থের অভাব এবং অল্প সংখ্যক অনুসারী।
পরবর্তীতে, ৩১৩ সালে রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্মকে বৈধতা দেওয়ার ফলে সামাজিকভাবে খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাপক প্রসার হয়। প্রাথমিক সময়ে খ্রিস্টানরা ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসরন করতো। খোদাই করা মূর্তি, কাঠ বা পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্য বা ফেটিশ উৎপাদনের বিরুদ্ধে ওল্ড টেস্টামেন্টের বিধি নিষেধ প্রাথমিক সময়ে শিল্প তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করেছিলো।
প্রাথমিক খ্রিষ্টানরা তৎকালীন পৌত্তলিক সংস্কৃতির মতো একই শৈল্পিক মাধ্যম ব্যবহার করতেন বলে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এই মাধ্যমসমূহের মধ্যে ছিল, ফ্রেস্কো, মোজাইক, ভাস্কর্য প্রভৃতি। কিন্তু, প্রাথমিক খৃষ্টান শিল্পে শুধুমাত্র রোমান ফর্ম ব্যবহার করা হয়নি। এতে রোমান শৈলীও ব্যবহৃত হয়েছিল। লেট ক্লাসিক্যাল শিল্পশৈলী প্রাথমিক খ্রিষ্টান ফ্রেস্কোতে দেখা যায়। যেমন – রোমের ক্যাটাকম্বস, যার মধ্যে প্রাচীনতম খ্রিস্টান শিল্পের বেশিরভাগ উদাহরণ রয়েছে।
খ্রিস্টধর্মের প্রারম্ভিক যুগে শিল্পের বিকাশের উপর এর গভীর প্রভাব ছিল। এখানে এই প্রভাবের উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এই তালিকায় প্রথমেই আসবে, প্রতীকবাদ এবং মূর্তিবিদ্যা। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্পে প্রায়ই ধর্মীয় বার্তা এবং শিক্ষা প্রদানের জন্য প্রতীকবাদ এবং প্রতিমাবিদ্যা ব্যবহার করা হতো। প্রারম্ভিক দিনগুলিতে শাসক শ্রেণীর অত্যাচারের কারণে সহবিশ্বাসীদের চিহ্নিত করতে সূক্ষ্ম চিহ্ন এবং লুকানো প্রতীক ব্যবহার করা হতো। উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক খ্রিস্টানদের মধ্যে একটি গোপন প্রতীক হিসাবে কাজ করতো মাছের প্রতীক (ইচথিস) ব্যবহার, যা যিশু খ্রিস্টের প্রতিনিধিত্ব করতো বলে বিশ্বাস করা হতো।
এছাড়া, ক্যাটাকম্ব আর্ট সম্পর্কেও আলোচনা অবশ্য করণীয়। ক্যাটাকম্ব বা ভূগর্ভস্থ কবরস্থান, প্রাথমিক খ্রিস্টান শিল্পের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। ক্যাটাকম্বগুলিতে ফ্রেস্কো, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য ধরণের শিল্প স্থান পায়, যা বাইবেলের দৃশ্যসমূহ, যেমন গুড শেফার্ড, যীশুর অলৌকিক ঘটনা এবং ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলোকে চিত্রিত করে। এই শিল্পকর্মগুলো বিশ্বস্তদের সান্ত্বনা প্রদান করতো এবং তাদেরকে ঈমানী শক্তি প্রদান করতো। রোমের ক্যাটাকম্বস সমূহে প্রাথমিক খ্রিষ্টান শিল্পের সবথেকে বেশি উদাহরণ পাওয়া যায়। ক্যাটাকম্বস পেইন্টিং গুলির মধ্যে বিখ্যাত কিছু শিল্প যথাক্রমে, মোসেস স্টাইকিং দ্যা রক; আবেন্টস; জোনাহ এন্ড দ্যা হুইল; নোয়াহ প্রেইং ইন দ্যা আর্ক ইত্যাদি যা ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে ধারণ করা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে বলা যেতে পারে, প্রাথমিক খ্রিষ্টান পেইন্টিং, রোমান শিল্পের অভিযোজন, ইহুদি এবং গ্রেকো-রোমান শিল্পের প্রভাব, উপাসনার স্থান এবং ব্যাসিলিকাস, আধ্যাত্মিক বিষয়াদি, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ব্যাসিলিকা, যিশুর চিত্রন এর মতো বিষয়গুলো নিয়েও।
প্রাথমিক যুগের খ্রিষ্টানরা শিল্পে রোমান মোটিফ ব্যবহার করলেও, তার মধ্যে কিছু পৌত্তলিক প্রতীক ছিলো, যা চিত্রকলায় নতুন অর্থ প্রদান করেছিলো। যেহেতু ধর্মটি খ্রিস্টাব্দ তৃতীয় শতক পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছিলো না, তাই খ্রিস্টান শিল্পীরা তাদের বিষয়বস্তু ছদ্মবেশে ব্যবহার করতেন। গৃহীত মোটিফসমূহের মধ্যে ছিলো ময়ূর, আঙ্গুরের লতা এবং ভালো রাখাল। এছাড়াও প্রাথমিক খ্রিস্টানরা তাদের নিজস্ব আইকোনোগ্রাফী তৈরি করেছিল। যেমন- মাছ ও রুটি শীর্ষক একটি ফ্রেস্কো। সান ক্যালিস্টোর ক্যাটাকম্বসে আবিষ্কৃত হয়েছে যা খ্রিস্টানদের জন্য আইকোনোগ্রাফী এবং ইউক্যারিস্টের প্রতিনিধি।
প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প রোমান সাম্রাজ্যের শৈল্পিক ঐতিহ্য থেকে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল, কেননা, খ্রিস্টধর্ম রোমান প্রেক্ষাপটে আবির্ভূত হয়েছিল। তাই, প্রথম থেকেই খ্রিস্ট প্রধান শিল্পে খ্রিস্টান থিমগুলিকে চিত্রিত করার জন্য রোমান শৈল্পিক কৌশল এবং শৈলী গ্রহণ করা হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রাথমিক খ্রিস্টীয় শিল্পে যীশু খ্রিস্টের চিত্রায়ন প্রায়শই রোমান সম্রাটদের আদর্শ চিত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ইহুদি এবং গ্রিকো-রোমান শিল্পের উপাদানসমূহকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলো প্রাথমিক খ্রিস্ট শিল্প। বাইবেলের আখ্যানের চিত্রায়ন এবং প্রতীকের ব্যবহারকে প্রভাবিত করেছিলো ইহুদি শিল্প, অন্যদিকে, গ্রিকো-রোমান শিল্প মানুষের চিত্র, স্থাপত্যের মোটিফ এবং রচনার জন্য অনুপ্রেরণা প্রদান করে।
খ্রিস্টধর্ম স্বীকৃতি এবং গ্রহণযোগ্যতা লাভ করার সাথে সাথে উত্সর্গীকৃত উপাসনা স্থান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্যাসিলিকাস, যা মূলত রোমান পাবলিক বিল্ডিং, খ্রিস্টান সমাবেশের স্থান হিসাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। এই ব্যাসিলিকাগুলোতে স্থাপত্য উপাদান, যেমন, গম্বুজ, খিলান, এবং এপস রয়েছে; যা রোমান স্থাপত্য শৈলীর জাঁকজমককে প্রতিফলিত করে।
প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প আধ্যাত্মিক থিমসমূহের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল, যার মধ্যে রয়েছে যীশু খ্রীষ্টের জীবন, সাধু ও শহীদদের গল্প এবং বাইবেলের বর্ণনা। এর লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় বার্তা, ভক্তি অনুপ্রাণিত করা এবং বিশ্বাসীদের নির্দেশনা প্রদান করা। আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুর উপর জোর দেওয়ার বিষয়টি খ্রিস্টান শিল্পকে তৎকালীন সময়ে প্রচলিত পৌত্তলিক শিল্প থেকে আলাদা করেছে।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রারম্ভিক পর্যায়ে খ্রিস্টান অনুষ্ঠান বা উপাসনা গোপনীয় ছিল। খ্রিস্টধর্ম সর্বসম্মতভাবে বৈধ হওয়ার আগ অবধি রোমান কর্তৃক নিপীড়নের প্রেক্ষিতে খ্রিস্টান উপাসনালয়গুলোকে অস্পষ্ট রাখার প্রয়োজন ছিলো। তাই ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়িতে উপাসনার কাজ করতে হতো, যা হাউস চার্চ হিসেবে পরিচিত ছিলো। ডুরা ইউরোপোসে একটি হাউস চার্চ এর অবশিষ্টাংশ আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে খ্রিস্টানরা গোপনে একত্রিত হতো। এটি প্রাচীনতম হাউস চার্চ হিসেবে পরিচিত। হাউস চার্চগুলো ছিলো ব্যক্তিগত বাড়ি, যা খ্রিস্টান গির্জায় রূপান্তরিত করা হয়েছিলো, খ্রিস্টান ধর্মের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য। কন্সটান্টিন সাম্রাজ্য খ্রিস্টান ধর্মকে বৈধতা দেওয়ার পরপরই এই ধর্মীয় শিল্পকলা এবং স্থাপত্য নির্মাণ ত্বরান্বিত হয় এবং হাউস চার্চের পরিবর্তে নতুন গির্জা নির্মাণ শুরু হয়।
প্রাথমিক খ্রিস্টান শিল্পকলায় বড় বালাই সাইজের ভাস্কর্য পাওয়া যায় না, কারণ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে প্রতিকৃতি তৈরির ব্যাপারে জারিকৃত তৎকালীন নিষেধাজ্ঞা। তবে ছোট আকারের রিলিফ ভাস্কর্যের উদাহরণ এই সময়ে খুঁজে পাওয়া যায়। সাধারণত সারকোফ্যাগাসে ব্যবহারের জন্য রিলিফ ভাস্কর্য বানানো হয়েছিল। এই রিলিফ ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে বিখ্যাত একটি শিল্পকর্ম হলো জুনিয়াস বাসসের সারকোফ্যাগাস। যা মার্বেল পাথরের উপর ৩৫৯ সালে তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়া গির্জাসমূহের জন্য পরবর্তীতে স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হতো।
গির্জাসমূহের জন্য স্থাপত্যের সূত্র অনুপযুক্ত ছিল। তাই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা ব্যাসিলিকা মডেল ব্যবহার করতেন। যার প্রতিটি পাশে একটি করে আইল এবং কেন্দ্রে নোভ ছিল। একপ্রান্তে একটি এপস সহ বিল্ডিংটিকে ক্রসিকর্ম আকৃতি দেওয়ার জন্য একপ্রান্তে ট্রান্সেপ্ট যুক্ত করা হয়েছিল। এরূপ গির্জার অন্যতম উদাহরণ হ্যালো ‘ওল্ড সেন্ট পিটার্স’ যা রোমের প্রাথমিক গির্জা গুলির মধ্যে একটি। গির্জার দেয়ালসমূহ পেইন্টিং দিয়ে সজ্জিত ছিল।
প্রাথমিকভাবে যীশুকে ময়ূর ঈশ্বরের মেষশাবক নোঙরের মাতা চিত্র-চিহ্ন দ্বারা পরোক্ষভাবে উপস্থাপন করা হতো। পরবর্তীতে মূর্ত প্রতীক ব্যবহার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে সিংহের খাদ্যে ড্যানিয়েল প্রাণীদের মনোমুগ্ধকর আর্ফিয়াস ইত্যাদি। প্রাক কন্সটান্টিন যুগের শেষের দিকে যিশুকে ভালভাবে চিত্রয়ন করা হয়েছিল। যেমন: যিশু একজন রক্তপাতরত মহিলাকে নিরাময় করেছেন, কিংবা দ্যা গুড শেফার্ড ইত্যাদি শীর্ষক ফ্রেস্কো তার মধ্যে অন্যতম। তবে প্রাথমিক খ্রিস্টান আর্টে যীশুর ক্রুসবিদ্ধ কোন ছবি বা চিত্র পাওয়া যায়নি, কারণ সম্ভবত, এই সময়ে রোমান সাম্রাজ্যে ক্রুসবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সাধারণ অপরাধের শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হতো।
এসব কথার ভীড়ে স্মরণে রাখা যায়, বর্তমান সময়ে প্রাথমিক খ্রিষ্টান যুগের শিল্পকলায় খ্রিস্টধর্মের প্রভাব পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্পের উপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাব আধুনিক যুগেও গুরুত্ব বহন করছে। এই গুরুত্বের প্রথমটি স্বভাবতই ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতি। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে। এটি বিশ্বাসের উত্সের সাথে এক বাস্তব লিঙ্ক হিসাবে কাজ করে এবং প্রারম্ভিক খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, অনুশীলন এবং চ্যালেঞ্জসমূহের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই শিল্প ফর্ম বোঝা ও উপলব্ধি করা আমাদের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রশংসা করতে সাহায্য করে।
এরপর বলা যায় আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণার বিষয়ে। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প গভীর আধ্যাত্মিক বার্তা এবং প্রতীক বহন করে, যা আজ বিশ্বাসীদের অনুপ্রাণিত করে। এই শিল্পকর্মগুলোতে চিত্রিত চিত্রাবলী এবং আখ্যানসমূহ শ্রদ্ধার অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে, ধর্মীয় বোঝাপড়াকে গভীর করতে পারে এবং বিশ্বাস ও ভক্তির একটি দৃশ্য উপস্থাপন করতে পারে।
ধর্মীয় শিক্ষা ও বিশ্বাসের বিষয়েও বার্তা পাওয়া যায় এই বিশেষ বিষয়ের পঠন অনুসারে। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্পের অধ্যয়ন ধর্মীয় শিক্ষা এবং বাইবেলের গল্প, ধর্মতাত্ত্বিক ধারণা এবং সাধু ও শহীদদের জীবন অনুসন্ধান করতে সক্ষম করে। এটি বিশ্বাসী এবং অ-বিশ্বাসী উভয়কেই ধর্মীয় শিক্ষা শেখাতে এবং যোগাযোগ করার জন্য একটি চাক্ষুষ সহায়তা হিসাবে কাজ করে।
প্রতীকী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রেও এই পাঠ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প জটিল ধর্মীয় ধারণাসমূহের প্রকাশ করার জন্য প্রায়শই প্রতীকবাদ এবং মূর্তিবিদ্যা নিযুক্ত করেছিল। আধুনিক খ্রিস্টধর্মে এই প্রতীকী ভাষাটির প্রাসঙ্গিকতা অব্যাহত রয়েছে। এই প্রতীকসমূহ বোঝা বিশ্বাসীদের তাদের বিশ্বাসের সাথে সংযোগ করতে এবং খ্রিস্টান শিল্পে এমবেড করা আধ্যাত্মিক অর্থ ব্যাখ্যা করতে সহায়তা করে।
এছাড়া, লিটারজিকাল এবং ভক্তিমূলক প্রসঙ্গেও খ্রিস্টধর্মের প্রাথমিক প্রভাব তর্কের টেবিলে জোর দিতে পারে। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্পটি লিটারজিকাল এবং ভক্তিমূলক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল এবং এটি এখনও আধুনিক খ্রিস্টান গীর্জাগুলোতে উপাসনার অভিজ্ঞতাকে উন্নত করতে পারে। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্পের উপাদানসমূহ সমসাময়িক লিটারজিকাল স্পেসে অন্তর্ভুক্ত করা ধারাবাহিকতার অনুভূতি তৈরি করতে পারে, উপাসকের ব্যস্ততাকে গভীর করতে পারে এবং বিশ্বাসের ঐতিহাসিক শিকড়ের সাথে একটি সংযোগ গড়ে তুলতে পারে।
একই সাথে, গোটা বিষয়টির শৈল্পিক প্রভাব অতুলনীয়। প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্প সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্য শিল্পের বিকাশে একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। এর শৈলীগত উপাদান, প্রতীকবাদের ব্যবহার এবং বিষয়বস্তু পরবর্তী শৈল্পিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে এবং আজও শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বিভিন্ন শৈল্পিক অভিব্যক্তির সাথে খ্রিস্টান থিমের সংমিশ্রণ সমসাময়িক শিল্পকে সমৃদ্ধ করে এবং বিশ্বাস ও সৃজনশীলতার মধ্যে সংলাপকে উৎসাহিত করে।
সর্বোপরি, প্রারম্ভিক খ্রিস্টান শিল্পের উপর খ্রিস্টধর্মের প্রভাব আধুনিক সময়েও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে, আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা প্রদান করে, ধর্মীয় শিক্ষায় সহায়তা করে, একটি প্রতীকী ভাষা প্রদান করে, উপাসনার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করে এবং শৈল্পিক অভিব্যক্তিকে প্রভাবিত করে। এটি খ্রিস্টান বিশ্বাসের প্রাথমিক ভিত্তি এবং এর সমসাময়িক প্রকাশের মধ্যে একটি সেতু হিসাবে কাজ করে।
পরিশেষে, খ্রিস্টধর্ম স্বীয় প্রাথমিক যুগে স্বকীয় প্রতীকবাদ, বিদ্যমান শৈল্পিক ঐতিহ্যের অভিযোজন এবং বাইবেলের বর্ণনার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রারম্ভিক খ্রিস্টীয় শিল্পকে প্রভাবিত করেছিল। খ্রিস্টধর্ম যখন বৃহত্তর সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে বিকশিত এবং পরিচয় প্রতিষ্ঠা করছিলো, সেই সময়ে শিল্পটি অভিব্যক্তি, শিক্ষা এবং বিশ্বাসের নিশ্চিতকরণের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়