ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল: নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ভারতবাসীর মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় সেনানী। দেশবন্ধুর দীক্ষা এবং স্বামী বিবেকানন্দর ভাবশিষ্যত্বে উদ্দীপ্ত নেতাজীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে কোনোদিনই সন্দেহ ছিলো না, তবে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত নেহরু এবং মওলানা আজাদের মতো দিগ্গজদের সান্নিধ্যে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম নেতাজীকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দান করলেও, তাঁর রাজনীতির পুরোটাই ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অধীন। তিনি নিজে প্রচুর বই পড়তেন, দেশ-বিদেশের নামী লেখকদের বই সংগ্রহে রাখতেন এবং তাঁর সহকর্মী ও সুহৃদ সবাইকে বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। তাই, দেশ গড়তে প্রয়োজনীয় রূপরেখা স্বল্প বয়সেই তিনি পরিকল্পনা ও প্রদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন; যার প্রমাণ তাঁর রচিত দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল, এন ইন্ডিয়ান পিলিগ্রিম, দ্যা ট্রু ইন্ডিয়ান, ড্রীমস অফ ইয়ুথ সহ অন্যান্য লেখনীতে বিদ্যমান। পিতার ইচ্ছা পূরণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ পূর্বক প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা পদে শীর্ষাসন দখল এবং স্বরাজের প্রত্যাশায় নির্দ্বিধায় তা ত্যাগ, দুটোই নেতাজীর মেধা ও স্বভিমানের প্রতীক। স্বীয় ধর্মচর্চায় নেতাজী বিন্দুমাত্র ত্রুটি না রাখলেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প তাঁকে কখনোই স্পর্শ করেনি। গোড়া থেকে অসাম্প্রদায়িক ঐক্যবদ্ধ ভারত গড়তে চেষ্টার কোন ত্রুটি তিনি রাখেননি। ফলত, যে কজন বাঙালী রাজনীতিক মনিষী উপমহাদেশীয় স্তরে ভারত, পাকিস্তান, মায়ানমার ও বাংলাদেশে আজও সর্বজন নমস্য, সেখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল নামটি- সুভাষ চন্দ্র বসু।
নেতাজী জনসম্মখে অতীত হয়েছেন প্রায় আট দশক পেরিয়েছে। ব্রিটিশ উত্তর বর্তমান উপমহাদেশের প্রতিটি স্বাধীন ভূখন্ডে নানা রকম অস্থিরতা বিদ্যমান। নেতাজী যে আদর্শ লালন করে সংগ্রাম করেছিলেন, তাঁর কিয়দংশও কখনো অর্জিত হয়নি। ব্রিটিশ কাচি ও ক্ষমতার নানামুখী লড়াইয়ে তাঁর পরম আকাঙ্ক্ষিত ঐক্যবদ্ধ ভারত আজ খন্ড-বিখণ্ড। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের সর্বত্র আজও অস্থিরতা বিদ্যমান। কোথাও ক্ষমতার লড়াই, কোথাও চলছে ধর্ম ও জাতপাতের দ্বন্দ্ব। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা কিংবা আদর্শিক সংগ্রাম না, বরঞ্চ সর্বত্র চলছে অন্ধ মিছিল-মিটিং, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও গা জোয়ারি সংগ্রাম। এর নামই কী স্বাধীনতা? নেতাজী কী এজন্যেই স্বীয় সকল সুখ-শান্তি ত্যাগ করে লড়াই করেছিলেন? এর সরল উত্তর, না; নেতাজী এই অন্ধভক্তদের দেশ গড়তে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন একটি বৃহৎ ভারত, ঐক্যবদ্ধ ভারত, যেখানে জাতি-ধর্মের নামে উঁচু-নিচু নির্ধারিত হবেনা। বরং, মেধার ভিত্তিতে, আদর্শের ভিত্তিতে, দেশপ্রেমের মাহাত্ম্যে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। অর্থনীতিতে এশিয়া তথা বিশ্বের সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে নির্বাচন অতি আসন্ন। সম্ভাব্য ক্ষমতা দখলের লড়াই কেন্দ্র করে চারদিকে বিরাজ করছে এক অস্থির পরিবেশ। গত পনেরো বছরে হাজারো উন্নয়ন ও ভালো কাজ করার পরও সরকারের চোখে চোখ রাঙাচ্ছে বিরোধীরা। জনগণও সরকার বিরোধীদের সমর্থন দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পদ্মা সেতুর মতো চরম উন্নয়ন সাধনের পরও সরকার কেন সম্পূর্ণ জনমত পাচ্ছে না? এর একমাত্র কারণ গত পনেরো বছরে ভাইলীগ ও সুবিধাবাদের রাজনীতির বাড়-বাড়ন্ত। বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিকদের নগন্য জ্ঞান, ছাত্র রাজনীতিতে সৃজনশীল নেতৃত্বকে উপেক্ষা এবং এলাকাভেদে সুবিধাবাদীদের মনোনয়ন দান, সবই সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। উঠতি তরুণ পাতিনেতাদের বিশাল ক্ষমতা প্রদান, ত্যাগী গুরুজনদের অবজ্ঞা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদানে ব্যর্থতা, সবই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলছে। তথাপি, পরিসংখ্যান ও সামগ্রিক বিবেচনায় দেশের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের অবদানকে অস্বীকার তো করা সম্ভবই নয়, বরঞ্চ ইতিহাসের সেরা বলেই মান্যতা দিতে কার্পণ্য করা উচিত হবেনা। কিন্তু তবুও পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে যেসব বাঁধা বর্তমান সরকারের রয়েছে, তাঁর প্রধানতম কারণ দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অভাব। গবেষণা নির্ভর পড়াশুনার অভাব।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মলগ্ন থেকেই অস্থির এক বাতায়নে বড় হচ্ছে। আজও সেই সঙ্কট থেকে রাষ্ট্রটি বেরিয়ে আসতে পারেনি। কার্যত পরোক্ষ সেনা শাসনের যাঁতাকলে পিষে মরছে সেখানকার সাধারণ জনতা। দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্ভবত সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ইমেজের নেতাকে কিছুদিন পূর্বেই অন্যায় রায় প্রদান পূর্বক জেলবন্দী করা হলো। মায়ানমারেও জনগণের রায়ে নির্বাচিত নেতাকে সরিয়ে সেনা শাসন জারি করার মাধ্যমে বিশ্ব থেকে একঘরে করে দেয়া হলো দেশটির আপামর জনতাকে
অন্যদিকে, ভারত রাষ্ট্রটিও স্বীয় নৈতিক অবস্থানে আর নেই। অসাম্প্রদায়িক ভারত ৭০ বছরে যে অগ্রগতি করেছিলো, বিগত দশ বছরে সে অবস্থান যেন অনেকটাই নাজুক। প্রগতি, উন্নয়ন কিংবা গবেষণা নির্ভর ভাবগাম্ভীর্য নয়, বরঞ্চ ধর্মান্ধতাই সেখানে প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক দশক যাবত। ভোটের ময়দানেও সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া ভারতের আনাচে কানাচে দৃশ্যমান। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতের চন্দ্রযান ৩ চাঁদে সফল অবতরণ করলেও বর্তমান সরকার আমলেই মনিপুরের মতো ঘটনা ঘটছে। কাশ্মীরে ৩৭০ বাতিল করলেও ঐতিহাসিক সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা। নেতাজীকে সম্মান দিতে গিয়ে ওল্টো তাঁকে আরএসএস বানানোর অপপ্রয়াস দেখা যাচ্ছে সর্বত্র।
পরিশেষে, এটুকুই বলবো, ভালো নেই ভারতীয় উপমহাদেশ। সর্বত্র এক ভ্যাপসা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। এসব সমস্যার সমাধান নিমেষেই সম্ভব হতো, যদি ১৯৪৫ এর ১৮ আগস্ট নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু অন্তর্ধান না নিতেন। বিমান দূর্ঘটনার কাহিনী (ভারত সরকারের তথ্যমতে সত্য) না সাজিয়ে, যদি তিনি প্রকাশ্যে থাকতেন, কিংবা পরবর্তীতে ভারত সরকারের বিরাগভাজন না হয়ে, তাঁদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় স্বাধীন দেশে প্রকাশ্যে আসতে পারতেন, দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারতেন, তবে অচিরেই বদলে যেতে পারতো গোটা অঞ্চলের ভাগ্য। মান্ধাতার আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থা কার্যকর না থেকে শিক্ষা, প্রশাসন ও স্বাস্থ্য সহ সর্বত্র আমরা স্বীয় আধুনিক রূপ দিতে পারতাম, যা একমাত্র নেতাজীই করতে পারতেন, কেননা ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, উপমহাদেশের অন্য কোনো নেতাই নতুন কিছু গ্রহণে প্রস্তুত ছিলেন না। সেজন্যেই অন্তর্ধানের আশি বছর পরও প্রাসঙ্গিক নেতাজী। প্রাসঙ্গিক তাঁর কর্ম, প্রাসঙ্গিক তাঁর আদর্শ। তাই বিস্মৃত বাঙালী মনে নেতাজীকে স্মরণ অবশ্য কর্তব্য। তবেই আসবে প্রকৃত প্রগতি। জয় বাংলা। জয় হিন্দ।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেহাদ