উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘রূপান্তর’ ও ‘পরশের’ উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনেই মূলত ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সুন্দরবন দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সে হিসেবে এবার পালিত হচ্ছে ২৪তম সুন্দরবন দিবস।
পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই আমরা দেখতে পাই, অসংখ্য বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে ত্রাতা হয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় সুন্দরবন। বিশেষ পর্যটন অঞ্চল হওয়ায় অর্থনীতিতেও সুন্দরবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ গোটা দেশের পরিবেশ। কিন্তু, প্রতিনিয়ত বনখেকোদের আগ্রাসনের ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন আজ হুমকির মুখে। আমাদেরই অসচেতনতায় প্রতিনিয়তই হুমকির মুখে পড়ছে সুন্দরবনের সব জীববৈচিত্র্য তথা সেখানে বসবাসরত মানব সম্প্রদায়।
বলতে দ্বিধা নেই, এভাবে চলতে থাকলে মানবসভ্যতার বেঁচে থাকার রসদও হারিয়ে যাবে একসময়। ব্যক্তি স্বার্থে প্রাণীকূলের বাস্তুসংস্থানের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলাতে বেশ সিদ্ধহস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। সেই সঙ্গে অল্প লাভের আশায় নিজেদের জীবন-জীবিকার দীর্ঘস্থায়ী সম্পদকে অবলীলায় বিসর্জন দিয়ে চলছি। এই ধ্বংসের মুখ থেকে নিজেদের ফিরিয়ে আনতে সুন্দরবন দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে মানবসভ্যতা নয়, বরং প্রকৃতির সান্নিধ্যেই জীবন ফিরে পায় নতুন রূপ।
সুন্দরবন দিবসের মাহাত্ম্য নিয়ে লিখতে গেলে গোটা দশেক বইতেও হয়তো লেখনীর সংকুলান ঘটবেনা। তবে, নাট্যকলা তথা সাহিত্যের একজন মনযোগী শিক্ষার্থী হিসেবে বলতে চাই, শুধুমাত্র বাস্তুসংস্থান, ভৌগলিক গুরুত্ব কিংবা অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার বিবেচনায় নয়, সুন্দরবনের লোকসাহিত্যও আমাদের জাতীয় পরিচয় তথা আমাদের শেকড়ের জানান দিতে গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. কামালউদ্দিন কবির স্যার এর বলা কিছু কথা মনে পড়ছে। স্যার তাঁর পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয়ে বাংলার গ্রামীণ সাহিত্য তথা গীতরঙ্গ-নিয়ে অনেক কাজই করেছেন। তিনি তাঁর ‘বাংলার গীতরঙ্গ’ পাঠে গোটা বিষয়টিকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন। এসব ভাগেরই অন্যতম মূল একটি অংশের নাম, জনআখ্যানমূলক গীতরঙ্গ; যাতে আশ্রিত পালা, যাত্রা, গীত, এবং কিস্সা বা কাহিনি।
তেমনই একটি গল্পের কথাও মনে পড়ছে, যা গোটা দক্ষিণাঞ্চলের লোকজ সাহিত্যে খুবই জনপ্রিয়। কাহিনীটির নাম ‘বনবিবি’। গল্পটি মূলত সুন্দরবন এলাকা সম্পর্কিত। সংক্ষেপে গল্পটি বলতে চেষ্টা করছি।
একদা ইব্রাহিম নামের এক আরব সওদাগর তার সহধর্মীনী গুলাল বিবিকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজে দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ায় বাণিজ্য যাত্রায় আসেন। আরব সাগরের সেই জাহাজটি বঙ্গোপসাগরের উপকূলে রায়মঙ্গলের মোহনায় থামে। গুলাল বিবি ছিলেন তখন সন্তান সম্ভবা। হয়তো কোথাও কোন সাহায্য না পেয়ে, কিংবা কোনো এক অজানা কারণে ইব্রাহিম সওদাগর তার স্ত্রীকে এই বনেই ত্যাগ করে সামনের দিকে যাত্রা করেন। অচেনা গহীন অরণ্যে একা থেকে গেলেন গুলাল বিবি।
সন্তান সম্ভবা গুলাল বিবির আর্তনাদ তথা দুঃখ দেখে পশুদের মনেও মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। তারা দলে দলে এগিয়ে আসে গুলাল বিবির সাহায্যার্থে। সকলে তাকে মায়ের মত ভালোবাসতে আরম্ভ করে। তিনিও বনের পশুগুলোকে সন্তান স্নেহ করতে লাগলেন। এই বনেই গুলাল বিবির যমজ সন্তান হয়। পুত্রের নাম রাখা হয়, শাহ জংলি এবং কন্যার নাম রাখা হয়, বনবিবি।
পরবর্তীতে পশুদের সহযোগিতায় সুন্দরবন এলাকার রামমঙ্গল, বাঁশখালি, আন্ধারমানিক সহ প্রভৃতি জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করে সারা বনের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে যান বনবিবি। তিনি হয়ে ওঠেন বনের মাতা। কেউ কেউ তাকে বনদেবীও বলে ডাকেন।
উপরের গল্পটি থেকেই বুঝা যাচ্ছে, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহের কত গভীরে লুকিয়ে রয়েছে সাহিত্যের অমূল্য সব সম্পদ। আমাদের জীবন নির্ভর আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে এরকম হাজারো গীতরঙ্গ। এসব কাহিনি আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ স্বরুপ। বর্তমান শহুরে জীবনের ঘনঘাটায় গ্রামীণ জনপদের এসব গীতরঙ্গ আমরা ভুলতে বসেছি।
তাই সুন্দরবন দিবসের এই শুভ ক্ষণে পাঠক কূলের প্রতি আকুতি, শুভ বুদ্ধির উদয় হোক আমাদের মস্তিস্ক ও মননে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি আমরা সচেতন হই দক্ষিণাঞ্চলের গীতরঙ্গ সংরক্ষণে। তবেই সার্থকতা পাবে এই লেখার উদ্দেশ্য। জাগ্রত হবে বাংলা সাহিত্যের ঘুমন্ত সম্ভার।
লেখক: শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (maemran7@gmail.com, ০১৫৫১৭২৫৯১১)