অধ্যাপক মোঃ জাকির হোসাইন: রাজনৈতিক ঐক্যের গুরুত্ব বিশেষত তখনই বেশি হয়ে ওঠে যখন কোনো জাতি সংকটকাল অতিক্রম করে। জাতিগত বিভাজন জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে, আর ঐক্যই এনে দেয় বিজয়। “ঐক্যবদ্ধ আমরা জিতি, বিভক্ত আমরা পরাজিত হই” – এটি সর্বজনবিদিত একটি বাণী। জাতীয় ঐক্যই একটি জাতির প্রকৃত শক্তি, যা কোনো কিছুতেই পরাজিত করা সম্ভব নয়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব জাতীয় ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বিজয় এনে দিয়েছে। এই বিপ্লব চলাকালীন যে ঐক্য সৃষ্টি হয়েছিল, তা আগামী কয়েক বছর ধরে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সময়ে আমাদের সামনে একমাত্র পথ হলো ঐক্যবদ্ধ থাকা।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ফসল। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অনন্য এবং নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক মাইলফলক। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের ফলে জনগণ স্বস্তি পেয়েছে এবং নতুন আশায় বুক বেঁধেছে।
বাংলাদেশের জনগণ ড. ইউনূসকে বর্তমান নেতা হিসেবে পেয়ে আনন্দিত এবং তার নেতৃত্ব নিয়ে আশাবাদী। দেশের বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি সত্ত্বেও ইউনূস সরকার জনগণের জন্য সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষতা প্রদর্শন করছে।
সরকার শুরু থেকেই অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারতের বর্তমান সরকার ড. ইউনূস সরকারের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণ করছে না, বরং তারা নানা ভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে সরকারের কার্যক্রম ব্যাহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই হুমকির গুরুত্ব অনুধাবন করে সরকার সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
এটি স্পষ্ট যে, সংকটকালীন সময়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মধ্যে মতবিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছে, যা জনগণের মধ্যে ভুল বার্তা প্রেরণ করছে।
জাতি যখন এই দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রত্যাশা করছে, তখন তাদের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারকে বহিরাগত হুমকি মোকাবিলায় সহযোগিতা করা। এই দুই দলের মধ্যে বিভাজন অবশ্যই বহিরাগত শক্তির জন্য সুযোগ তৈরি করবে, যা তারা সহজেই কাজে লাগাবে।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যারা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে ছিল তাদের কে সম্মানের সহিত জাতীয় ঐক্যমতে সম্পৃক্ত করা।
রাজনীতি সবসময় জনগণ ও দেশের জন্য, এবং সেটিই সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাবে। ব্যাক্তিগত ও দলীয় স্বার্থকে সবসময় জাতীয় স্বার্থের উপরে মর্যাদা দিতে হবে। উভয় দলকে সংলাপে বসে জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার পথ বের করতে হবে। এর বাইরে যেকোনো পদক্ষেপ জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ছাত্র নেতাদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে নিরুৎসাহিত করা উচিত নয়, বরং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর তা স্বাগত জানানো উচিত। তাদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন, যাতে তারা নতুন বাংলাদেশের গঠনে অবদান রাখতে পারে। তাদের নিজস্ব একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থাকতে পারে এবং তারা তাদের ঘোষণাপত্র সহকারে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এতে কোনো সমস্যা নেই, তবে তাদের ক্ষমতার রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রয়োজনে তারা সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে।
জাতীয় স্বার্থে বড় বা ছোট সব রাজনৈতিক দলকে আগামী কয়েক বছর ধরে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যতদিন না দেশ স্থিতিশীল হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হয়। অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ কোনোভাবে মোকাবিলা করা গেলেও, বহিরাগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অনেক কঠিন।
ভারত সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। জাতি কেবল তখনই তাদের কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারবে, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব। এটি আমাদের জন্য পরিবর্তনের শেষ সুযোগ, তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর সব দায় চাপানো ঠিক হবে না। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে এবং সবকিছু একসঙ্গে দ্রুত সমাধানের আশা করা উচিত নয়। সময় সুযুগ ও পরিবেশ নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। জাতীয় ঐক্যমতের সিদ্ধান্ত উপর দৃঢ়তা থাকতে হবে। সর্বোপরি মহান আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে হবে। তবেই বাঞ্ছনীয় লক্ষ্য অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
লেখক: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ।