বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও শনাক্ত হয়েছে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) রোগী। এরই মধ্যে রোগটির জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেছেন বাংলাদেশের এক নারী। শ্বাসযন্ত্রের সিনসিটিয়াল ভাইরাসসহ নিউমোভিরিডি পরিবারের অন্তর্গত এ ভাইরাস। ২০০১ সালে এটি প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল, এরপর বহু মানুষের মধ্যে সেটি ছড়িয়ে পড়েছে।
যেকোনো বয়সীদের মধ্যেই ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। তবে শিশু ও বয়স্কদের পাশাপাশি যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য ভাইরাসটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
উপসর্গ
সাধারণত এইচএমপিভি সংক্রমিত ব্যক্তিদের লক্ষণ ও উপসর্গ থাকে সর্দি বা ফ্লুর মতোই। এর সাধারণ কিছু উপসর্গের মধ্যে আছে: খুসখুসে কাশি ও জ্বর, পাশাপাশি গলাব্যথা; সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে থাকা এবং শ্লেষ্মা ঝরা; পুরো শরীরব্যথা ও মাথাব্যথা; শিশুদের ক্ষেত্রে খাওয়ায় অনীহা ও দেহে অস্বস্তি ইত্যাদি।
গুরুতর লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে
রোগটি মারাত্মক আকার ধারণ করলে ভাইরাসটি ফুসফুসের সংক্রমণ, যেমন—নিউমোনিয়া বা ব্রংকাইটিস তৈরি করতে পারে। শ্বাসনালিতে প্রদাহ, যেমন—ব্রংকিওলাইটিস বা ব্রংকাইটিসের মতো মারাত্মক জটিলতাও সৃষ্টি হওয়ার নজির আছে।
যেভাবে ছড়ায়
এইচএমপিভি ছড়ায় শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য ভাইরাসের মতোই। আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচি থেকে নিঃসরণ, হাত মেলানো বা শরীরের অন্য স্থানে স্পর্শ করা, সংক্রমিত স্থান স্পর্শ করার পর একই হাতে মুখ, নাক বা চোখ স্পর্শ করলে ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় এই ভাইরাস ভালোভাবেই টিকে থাকে, তাই শীত মৌসুমে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সাধারণত মানুষ ঘরের মধ্যে বেশি সময় থাকে, সেই বদ্ধ পরিবেশ ভাইরাসটি ছড়ানোয় সহায়ক।
ঝুঁকিতে যারা
একজন ব্যক্তি কতটা অসুস্থ হবে সেটি তার সামগ্রিক স্বাস্থ্যসহ আরো অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তি বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, যেমন—অ্যাজমা বা সিওপিডি আছে যাদের, অথবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল যাদের, যেমন—ক্যান্সার বা এইডস আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতার ঝুঁকি অনেক বেশি। এই ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের রোগটি থেকে রক্ষা পেতে অতিরিক্ত সতর্কতার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বর্তমানে এইচএমপিভির বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য উপযোগী লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোনো ভ্যাকসিন নেই। তবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে।
চিকিৎসা
এখনো কোনো অনুমোদিত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আবিষ্কার হয়নি বলে এইচএমপিভি সংক্রমণের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। রোগটিতে আক্রান্তরা বেশির ভাগই অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সেরে যায়। সাধারণ সর্দি-কাশি ও জ্বরের জন্য যেসব ওষুধ দেওয়া হয়, এইচএমপিভির চিকিৎসা হিসেবে তা-ই যথেষ্ট। পাশাপাশি রোগীকে বিশ্রাম নিতে হবে এবং পানি খেতে হবে বেশি বেশি। তবে উপসর্গের প্রকোপ বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষ ব্যবস্থায় চিকিৎসা করা প্রয়োজন। অবশ্য খুব অল্প সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রেই তা প্রয়োজন হয়ে থাকে।
প্রতিরোধে করণীয়
এইচএমপিভি সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতার বিকল্প নেই। এ জন্য যা করা উচিত—
সাবান পানি বা অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করা।
দরজার হাতল স্পর্শের পর চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করবেন না।
দরজা, জানালা, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার কি-বোর্ড ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত রাখুন।
ঘরের বাইরে জনাকীর্ণ বা দুর্বল বায়ু চলাচল রয়েছে এমন স্থানে গেলে অবশ্যই মাস্ক পরুন।
জ্বর ও সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকুন।
ঘর বা অফিস আবদ্ধ রাখবেন না।
কাশি বা হাঁচির সময় টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করুন। ব্যবহৃত টিস্যু নিরাপদে ফেলে দিন।
দেহের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী রাখতে পর্যাপ্ত সুষম খাবার খান, পর্যাপ্ত পানি ও তরল গ্রহণ করুন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন, সঠিকভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করুন।
খেজুরের কাঁচা রস পান করবেন না। যেসব ফল বাদুড় খায়, সেসব খেতে সাবধানতা অবলম্বন করুন।
চিকিৎসকের পরামর্শে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে পারেন। যদি একান্তই সংক্রমণ ঘটে তবে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রাখুন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। রোগটি নতুন নয়, বাংলাদেশেসহ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক থাকা উচিত।
লেখক: অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়