১২:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিত্যদিনের প্লাস্টিক, নিত্যনতুন বিপদ

প্লাস্টিক—বিশ্বায়নের যুগে যার উপস্থিতি সর্বত্র। প্যাকেজিং থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সামগ্রী, চিকিৎসা উপকরণ, কৃষিকাজ কিংবা দৈনন্দিন কেনাকাটা—প্লাস্টিক ছাড়া যেন কিছুই কল্পনা করা যায় না। ১৯০৭ সালে লিও হেনড্রিক বেকেল্যান্ড যখন প্রথম সিনথেটিক প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেন, তখন হয়তো কল্পনাও করেননি এই আবিষ্কার একদিন পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠবে।

বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত এই পণ্যটি প্রধানত পেট্রোলিয়ামজাত উপাদান থেকে তৈরি হয় এবং সাধারণত HDPE, LDPE ও LLDPE—এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। পাতলা হলেও শক্তিশালী এসব ব্যাগ গড়পড়তা ৪-৫ গ্রাম ওজনের হলেও প্রায় ১৭ পাউন্ড পর্যন্ত ভার বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এ-সুবিধার আড়ালে যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়, তা অবহেলা করার সুযোগ নেই।

পরিবেশে প্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব আজ বিশ্বজুড়ে চরমভাবে আলোচিত। প্রথমত, এটি প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট করে। মাটিতে পড়ে থাকা প্লাস্টিক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং কৃষিজ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, এটি বন্যপ্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি। ভুলবশত প্লাস্টিক খেয়ে বহু প্রাণী মৃত্যুবরণ করছে। তৃতীয়ত, এটি অপচনশীল। সূর্যালোকে প্লাস্টিক ভেঙে ক্ষুদ্র বিষাক্ত কণায় পরিণত হয়, যা শত শত বছর ধরে পরিবেশে থেকে যায়। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক মাটির সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করে তোলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হয়, যার ফলে লক্ষাধিক সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্তির মুখে পড়ে। বর্তমানে সমুদ্রের বুকে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের অবস্থান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু প্রকৃতি নয়, মানবদেহেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, জন্মগত জটিলতা—এমন বহু রোগের সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের মধ্যে অনেকেই গরম খাবার প্লাস্টিক ব্যাগে বহন করি, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় খাবারে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একজন মানুষ প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫ গ্রাম প্লাস্টিক অনিচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করছে, যা বার্ষিক হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ২৫০ গ্রাম।

তবে, সবদিকেই কিছু ইতিবাচক দিক থাকে। প্লাস্টিকের হালকা ওজনের কারণে প্যাকেজিং সহজ হয় এবং জ্বালানি সাশ্রয় ঘটে, যা পরিবহনে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে সহায়তা করে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।

তবুও, প্রশ্ন থেকে যায়—এই ব্যবহারের যৌক্তিকতা কতটুকু? টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই পরিবেশবান্ধব এবং পচনশীল বিকল্প বেছে নিতে হবে। কাগজ কিংবা পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক আলাদা করে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক বর্জনের অভ্যাস গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। বিশেষত PVC ও Polypropylene জাতীয় প্লাস্টিক যেগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়—এসব থেকে দূরে থাকাটাই হবে অধিকতর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।

পরিবেশ রক্ষায় ব্যক্তিগত সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সমন্বিত প্রয়োগ জরুরি। অন্যথায়, এই উন্নয়নই একদিন আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লেখক: সানজিদা আক্তার, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, ১৩৪২। যোগাযোগ: [email protected]

Translate

নিত্যদিনের প্লাস্টিক, নিত্যনতুন বিপদ

প্রকাশ: ০৭:১১:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

প্লাস্টিক—বিশ্বায়নের যুগে যার উপস্থিতি সর্বত্র। প্যাকেজিং থেকে শুরু করে গৃহস্থালির সামগ্রী, চিকিৎসা উপকরণ, কৃষিকাজ কিংবা দৈনন্দিন কেনাকাটা—প্লাস্টিক ছাড়া যেন কিছুই কল্পনা করা যায় না। ১৯০৭ সালে লিও হেনড্রিক বেকেল্যান্ড যখন প্রথম সিনথেটিক প্লাস্টিক উদ্ভাবন করেন, তখন হয়তো কল্পনাও করেননি এই আবিষ্কার একদিন পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে উঠবে।

বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত এই পণ্যটি প্রধানত পেট্রোলিয়ামজাত উপাদান থেকে তৈরি হয় এবং সাধারণত HDPE, LDPE ও LLDPE—এই তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। পাতলা হলেও শক্তিশালী এসব ব্যাগ গড়পড়তা ৪-৫ গ্রাম ওজনের হলেও প্রায় ১৭ পাউন্ড পর্যন্ত ভার বহন করতে সক্ষম। কিন্তু এ-সুবিধার আড়ালে যে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়, তা অবহেলা করার সুযোগ নেই।

পরিবেশে প্লাস্টিকের নেতিবাচক প্রভাব আজ বিশ্বজুড়ে চরমভাবে আলোচিত। প্রথমত, এটি প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট করে। মাটিতে পড়ে থাকা প্লাস্টিক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং কৃষিজ উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, এটি বন্যপ্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি। ভুলবশত প্লাস্টিক খেয়ে বহু প্রাণী মৃত্যুবরণ করছে। তৃতীয়ত, এটি অপচনশীল। সূর্যালোকে প্লাস্টিক ভেঙে ক্ষুদ্র বিষাক্ত কণায় পরিণত হয়, যা শত শত বছর ধরে পরিবেশে থেকে যায়। ক্লোরিনযুক্ত প্লাস্টিক মাটির সঙ্গে সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করে তোলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর প্রায় ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমা হয়, যার ফলে লক্ষাধিক সামুদ্রিক প্রাণী বিলুপ্তির মুখে পড়ে। বর্তমানে সমুদ্রের বুকে আনুমানিক ১০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের অবস্থান রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু প্রকৃতি নয়, মানবদেহেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, চর্মরোগ, জন্মগত জটিলতা—এমন বহু রোগের সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের মধ্যে অনেকেই গরম খাবার প্লাস্টিক ব্যাগে বহন করি, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় খাবারে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একজন মানুষ প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫ গ্রাম প্লাস্টিক অনিচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করছে, যা বার্ষিক হিসাবে দাঁড়ায় প্রায় ২৫০ গ্রাম।

তবে, সবদিকেই কিছু ইতিবাচক দিক থাকে। প্লাস্টিকের হালকা ওজনের কারণে প্যাকেজিং সহজ হয় এবং জ্বালানি সাশ্রয় ঘটে, যা পরিবহনে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে সহায়তা করে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।

তবুও, প্রশ্ন থেকে যায়—এই ব্যবহারের যৌক্তিকতা কতটুকু? টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই পরিবেশবান্ধব এবং পচনশীল বিকল্প বেছে নিতে হবে। কাগজ কিংবা পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক আলাদা করে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক বর্জনের অভ্যাস গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। বিশেষত PVC ও Polypropylene জাতীয় প্লাস্টিক যেগুলো পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়—এসব থেকে দূরে থাকাটাই হবে অধিকতর বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।

পরিবেশ রক্ষায় ব্যক্তিগত সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার সমন্বিত প্রয়োগ জরুরি। অন্যথায়, এই উন্নয়নই একদিন আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

লেখক: সানজিদা আক্তার, স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, ১৩৪২। যোগাযোগ: [email protected]