আগাম বর্ষায় দেশের বিভিন্ন নগরীতে দেখা দেওয়া জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে খাল ও জলাশয় দখলদারদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, জলাবদ্ধতার প্রকৃত সমাধান কেবল প্রকল্প বা অর্থ ব্যয়ে নয়, বরং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান ও সমন্বিত নগর পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই সম্ভব।
মঙ্গলবার (০৩ জুন) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। “আগাম বর্ষায় নগর এলাকায় জলাবদ্ধতা: আইপিডি’র পর্যবেক্ষণ” শীর্ষক এই আলোচনায় দেশের বিভিন্ন শহরে জলাবদ্ধতার কারণ ও করণীয় তুলে ধরা হয়।
মূল প্রবন্ধে আইপিডির পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে গত কয়েক বছরের নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও জলাবদ্ধতা প্রশমনে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। বরং ঢাকার আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের পুনঃভরাটসহ অনেক খাল-জলাশয় পুনরুদ্ধার প্রকল্প কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বর্ষায় ভোগান্তি বেড়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা দখলদারদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়াই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
ময়মনসিংহ থেকে আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানার্স, ময়মনসিংহ জেলা শাখার সদস্য সচিব পরিকল্পনাবিদ ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল বলেন, “নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে অত্র শহর জুড়ে গড়ে উঠছে ব্যাপক রিয়েল এস্টেট ব্যবসা। নগর কর্তৃপক্ষ যেন নির্বিকার। এতে শহরের স্বাভাবিক মৌলিকত্ব হারিয়ে যাচ্ছে; পরিণত হচ্ছে এক কৃত্রিম দেয়ালঘেরা আবাসন নগরীতে, যা দেশের বেশিরভাগ বড় শহরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
তিনি আরও বলেন, “ব্রহ্মপুত্র নদীর নাব্যতা নিয়ে কাজ চলছে আজ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিই এখনও হয়নি। বরঞ্চ, প্রতিবছরই প্রকল্পের মেয়াদ ও বাজেট বাড়ানোর খবর শুনা যায়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। রাস্তা বড় করার পরিবর্তে প্রতিবছর রাস্তা উঁচু করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ফলত, বর্ষণ দিন বা সন্ধ্যায় জলাবদ্ধতা ময়মনসিংহবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠছে।”
আলোচনায় আরও অংশ নেন, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজালাল মিশুক, জুরাইন পরিবেশ আন্দোলনের নেতা মিজানুর রহমান মিজান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা, খুলনা থেকে সংযুক্ত হয়ে পরিকল্পনাবিদ শেখ আদনান ইসলাম, পরিবেশবিদ আসিফ ইকবাল, কুমিল্লা থেকে পরিকল্পনাবিদ ইবতেছাম রাশেদীন নাজলা, রংপুরের পরিকল্পনাবিদ মো. রেদওয়ানুর রহমান, বরিশাল থেকে পরিকল্পনাবিদ আব্দুল আহাদ নাফিস।
বক্তারা বলেন, “খাল-জলাশয় দখলকারীরা প্রায়ই রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলে দখলদারদের আইনের আওতায় আনতে হবে।”
আইপিডি আলোচনায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ১২টি সুপারিশ উপস্থাপন করে, যার মধ্যে রয়েছে—জলপ্রবাহের স্বাভাবিক পথ সংরক্ষণ, খাল-পুকুর-জলাধার রক্ষা ও পুনরুদ্ধার, নগর এলাকায় সবুজ ও জলাশয়ের নির্ধারিত অনুপাত নিশ্চিতকরণ, আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমন্বয়, আইন প্রয়োগ জোরদার, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।